শোভন-রাব্বানীকে পাত্তাই দিচ্ছেন না পদবঞ্চিতরা, আন্দোলনে ইন্ধন দিচ্ছে কালো সিন্ডিকেট!

- ৭-Jun-২০১৯ ০১:২৪ পূর্বাহ্ণ
উৎপল দাস
বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি পুনর্গঠনের দাবিতে টানা ১৩ তম দিনে অবস্থান কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছেন পদবঞ্চিতরা। এমনকি ছাত্রলীগের বাকি সবাই যখন পরিবার পরিজনের সঙ্গে ঈদ আনন্দ করছেন, তখন তারা মায়ের কাছে না গিয়ে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে ঈদ উদযাপন করেছেন। ঈদের পরও সেই ধারা অব্যাহত রেখেছেন শুধু বিতর্কহীন ছাত্রলীগের কমিটি দেখার অপেক্ষায়। এমনকি ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর কোনো আশ্বাসকেই পদবঞ্চিতরা পাত্তা দিচ্ছেন না। ঈদের আগে পদবঞ্চিতদের সঙ্গে কয়েক দফা দেখা করেও তাদের অবস্থান কর্মসূচী থেকে ফিরে আসার বিষয়ে কোনো সুরাহা করতে পারেননি শোভন-রাব্বানী। তবে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছ থেকে কয়েকজন পদবঞ্চিত নেতা (শোভন-রাব্বানীর অনুসারী) ঈদের সালামি নিয়েছেন বলে জানা গেছে। তখন অনেকেই বলেছিলেন, ঈদ করতে বাড়ি যাবেন; কিন্তু তারা শোভন-রাব্বানীকে দেয়া কথা রাখেননি। এমনকি পদবঞ্চিতদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন যারা দিনের বেলায় টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে আন্দোলন করছেন, কিন্তু রাতের অন্ধকারে শোভন-রাব্বানীর বাসায় গিয়ে কমিটিতে পদ পাওয়ার জন্য হাতে পায়ে ধরছেন এবং আন্দোলন করার জন্য ক্ষমা প্রার্থনাও করছেন। ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে আন্দোলনকারীরা মাঝে মধ্যে হাসিঠাট্টা করেও সময় পার করছেন। ধারাবাহিকভাবে কেউ না কেউ অবস্থান কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদবঞ্চিতদের আন্দোলনের পিছন থেকে ইন্ধন যুগাচ্ছেন ছাত্রলীগেরই অশুভ একটি কালো সিন্ডিকেটের কয়েকজন সদস্য। এক্ষেত্রে সাবেক কমিটির দুই শীর্ষ নেতার দিকেই অভিযোগের তীর তুলেছেন ছাত্রলীগেরই একটি অংশ। তারা বলেছে, ছাত্রলীগের সাবেক দুই শীর্ষ নেতা নিজেদের পছন্দের লোকদের কমিটিতে রাখতে না পেরে এই আন্দোলন এখনো চালিয়ে যেতে নানা ধরণের সাহায্য সহযোগিতা করে যাচ্ছেন গোপনে এবং প্রকাশ্যে। কয়েকজন আন্দোলনকারীর সঙ্গে সাবেক ছাত্রলীগের শীর্ষ এক নেতার সঙ্গে একটি গোপন বৈঠকও প্রতিনিধির মাধ্যমে হয়েছে বলে নিশ্চিত হয়েছে ভোরের পাতা। ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক কমিটির শীর্ষ দুই নেতা মধ্যে একজন যার বাড়ি পদ্মার ওপাড়ে, তিনি সরাসরিই এই আন্দোলনে ইন্ধন দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। যদিও এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সাবেক সেই নেতার কোনো মতামত পাওয়া যায়নি।
এদিকে, ঈদের দিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে নামাজ পড়ে পদবঞ্চিতরা আবারও সেখানে বসেন তারা। এসময় সেখানে গিয়ে পদবঞ্চিতদের সেমাই খাওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান।
উল্লেখ্য, গত ২৬ মে থেকে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে টানা অবস্থান নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন পদবঞ্চিতরা। কমিটি পুনর্গঠন না হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
সম্মেলনের এক বছর পর গত ১৩ মে ছাত্রলীগের ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হলে তা পুনর্গঠনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশিত পদ না পাওয়ারা। তাদের অভিযোগ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বয়সসীমা অতিক্রম করা, বিবাহিত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, চাকরিজীবী ও বিভিন্ন মামলার আসামিসহ নানা অভিযোগবিদ্ধ অনেককে পদ দেয়া হয়েছে। বঞ্চিত করা হয়েছে অনেক ত্যাগী নেতাকে।
ছাত্রলীগের গত কমিটির মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপ-সম্পাদক আল মামুন বলেন, আমরা ১৩ তম দিনের মতো অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছি। কেন্দ্রীয় মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করেছি। ভিসি স্যার (অধ্যাপক আখতারুজ্জামান) আমাদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। সবকিছুর পরেও আমরা কলঙ্কমুক্ত ছাত্রলীগ চাই। কেননা জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগে কোনো যুদ্ধাপরাধীর ছেলে যদি নেতা হতে পারে তাহলে আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান রয়েছি, তারা কেন পদ পাবে না? তাহলে কি ছাত্রলীগে আজ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরোধীরা ঠাঁই পাবে? এমন প্রশ্ন রেখে আল মামুন আরো বলেন, আমরা বিতর্কহীন ছাত্রলীগ প্রত্যাশা করেছিলাম। কিন্তু আমাদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে।
আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র গত কমিটির কর্মসূচি ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক রাকিব হোসেন বলেন, আমরা জোর দাবি জানিয়েছিলাম ঈদের আগেই যেন বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। আমাদেরও ইচ্ছা ছিল পরিবারের সঙ্গে ঈদ করার। কিন্তু তারা (কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ) আন্তরিক ছিল না। বিতর্কিতদের ঈদ করার সুযোগ দিয়ে আমাদের পরিবারের বাইরে করালো। আমরা আমাদের কর্মসূচি চালিয়ে যাবো। এমনকি যে ১৯ জনের পদ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র না মেনেই শূণ্য ঘোষণা করা হয়েছে, তাদের নাম কেন প্রকাশ করা হচ্ছে না। এর পেছনে কি উদ্দেশ্য রয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন রাকিব হোসেন। তিনি বলেন, আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল ছাত্রলীগের সর্বোচ্চ অভিভাবক শেখ হাসিনা। উনি যে সিদ্ধান্ত দিবেন তা আমরা মাথা পেতে মেনে নিবো। কিন্তু ছাত্রলীগে মাদকাসক্ত, বিবাবিহ, জামায়াত-বিএনপি পরিবারের সদস্যরা যখন কমিটিতে ঠাঁই পায়; তখন আমাদের লজ্জা লাগে। আমরা শুধু বিতর্কিতের বিরুদ্ধে কথা বলছি, তাদের অবশ্যই এই কমিটি থেকে বাদ দিয়ে যোগ্য, যাদের পরিবারিক আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তাদের ঠাঁই দিতেই হবে। আমরা বিশ্বাস করি, শেখ হাসিনা (আপার) ছাত্রলীগে স্বাধীনতা বিরোধী, বিএনপি-জামায়াত পরিবারের কেউ ঠাঁই পাবে না। এ বিষয়ে আমরা নেত্রীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছি।
অবস্থান কর্মসূচিতে থাকা অন্যরা হলেন- গত কমিটির উপ-দপ্তর সম্পাদক নকিবুল ইসলাম সুমন, উপ-কর্মসূচি ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক মুরাদ হায়দার টিপু, স্কুলছাত্র বিষয়ক সম্পাদক জয়নাল আবেদীন, সমাজসেবা সম্পাদক রানা হামিদ, কবি জসিমউদদীন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহেদ খান প্রমুখ।
এদিকে, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী ভোরের পাতাকে বলেন, পদবঞ্চিত ছাত্রলীগ নেতাদের পাশে আমরাও আছি। ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের সব সময় খোঁজ খবর নিচ্ছি। গণতান্ত্রিক উপায়ে তাদের অবশ্যই আন্দোলন করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু কয়েকবার গিয়েও আমরা তাদের বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। ১৯ জনের পদ শূণ্য করার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগ সভানেত্রী দেশে ফেরার পর দায়িত্বপ্রাপ্ত জাতীয় ৪ নেতার সঙ্গে আলোচনা করেই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করা হবে বলেও আমরা পদবঞ্চিতদের ঈদের আগেই জানিয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমার কথা না শুনে কোনো বিশেষ সিন্ডিকেটের কথায় এই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। রাব্বানী আরো বলেন, শেখ হাসিনার ছাত্রলীগকে বারবার বিতর্কিত করতে একটি মহল সব সময়ই তৎপর রয়েছে। কিন্তু তাদের শক্তভাবে মোকাবিলা করার ক্ষমতা রয়েছে বর্তমান ছাত্রলীগের এমন প্রচ্ছন্ন হুমকিও দিয়েছেন ছাত্রলীগের মানবিক ছাত্রনেতা হিসাবে পরিচিতি পাওয়া গোলাম রাব্বানী। আন্দোলনকারীদের উচিত ছিল আমাদের সবার নেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করা এবং এই আন্দোলন স্থগিত করে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে পরিবার পরিজনের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করা। কিন্তু তারা সেটি কেন, কার বুদ্ধিতে করেনি; তা সময়মতো প্রকাশ হবে। এই আন্দোলনের পিছন থেকে যদি কেউ কলকাঠি নাড়তে থাকেন, তাহলে তার বিষয়েও আপার (শেখ হাসিনা) কাছে তা জানানো হবে বলেও জানান ছাত্রলীগের মেধাবী এই সাধারণ সম্পাদক।