ওবায়দুল কাদের-জাহাঙ্গীর নানক স্নায়ুযুদ্ধে বলির পাঠা ‘শেখ হাসিনার’ ছাত্রলীগ!

- ১৩-Jun-২০১৯ ০৯:১৫ পূর্বাহ্ণ
:: উৎপল দাস ::
এক মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে, শেখ হাসিনার ছাত্রলীগের চলমান সংকট নিরসন হচ্ছে না। ছাত্রলীগকে কলংকমুক্ত না হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগের শীর্ষ দুই নেতার স্নায়ুযুদ্ধ। এই স্নায়ুযুদ্ধের পেছনে ক্ষমতাসীন দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতার সাধারণ সম্পাদক পদটি নিয়ে প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার কারণেই খোদ শেখ হাসিনার ছাত্রলীগের কমিটিকে বলির পাঠা বানিয়ে নিজেদের ক্ষমতা দেখানোর চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক অন্দরমহলে যোগাযোগ করে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্রলীগের এ চলমান সংকট নিরসন না হওয়ার নেপথ্য কারণ হচ্ছে আওয়ামী লীগের আগামী ২১ তম সম্মেলনে দলের ‘সাধারণ সম্পাদক’ পদের লড়াইয়ে অবর্তীণ বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগের সোনালী দুঃসময়ের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল এবং সংসদ সদস্য পদ হারানো যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক। আওয়ামী লীগের ‘ পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক’ পদ নিয়ে এ ঠান্ডাযুদ্ধের বলির পাঠা হচ্ছে বর্তমান ছাত্রলীগ।
ভোরের পাতার এ প্রতিবেদক আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডনের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য তার সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে।
প্রভাবশালী একজন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেছেন, ছাত্রলীগ নিয়ে ওবায়দুল কাদের এবং জাহাঙ্গীর কবির নানকের মধ্যে মৌনযুদ্ধ চলছে। কারণ তার দুইজনই ছাত্রলীগের শীর্ষপদে ছিলেন। বিশ্বাস করি, তাদের কাছে ছাত্রলীগ মানেই সোনালী অতীতের শক্তি, প্রেম ও আবেগ। তাই ছাত্রলীগ নিয়ে এখনো তারা ইতিবাচক ভাবেন। ওবায়দুল কাদের এবং জাহাঙ্গীর কবির নানক দুজনই জানেন, ছাত্রলীগই আওয়ামী লীগ রাজনীতির আতুঁরঘর। এই আঁতুরঘর ঠিক না রেখে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর কাছে কেউ পাত্তা পাবেন না।
রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে রাজনৈতিক চা চক্রের আড্ডায় আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য আরো বলেন, ছাত্রলীগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেগের নাম। এই সংগঠনটিকে তিনি হৃদয়ে ধারণ করেন। শেখ হাসিনাই হচ্ছেন ছাত্রলীগের পরিপূর্ণ গঠনতন্ত্রের নাম। কিন্তু বর্তমান কমিটিতে বিতর্কিতদের ঠাঁই দিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ৪ নেতা প্রথমেই ভুল করেছেন। সেক্ষেত্রে সবচে কম ভুল করা জাহাঙ্গীর কবির নানককেই বেশি দায়বার নিতে হচ্ছে। কারণ তাকেই মূল দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। চা চক্রের একপর্যায়ে প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেই বসলেন, জাহাঙ্গীর কবির নানক নয়, ছাত্রলীগে সবচে বেশি বিতর্কিত নেতা ঢুকিয়েছেন আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা আব্দুর রহমান। এছাড়া সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল ও বাহাউদ্দিন নাসিম সেখানে তেমন একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। আব্দুর রহমান কমিটি পূর্ণাঙ্গ হওয়ার আগে কয়েকদিনের মধ্যেই যে ১০ টি নাম প্রস্তাব করে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর কাছে পাঠিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ৮ জনই নারী নেত্রী। বাকি দুইজনের মধ্যে একজন তার রক্তের সম্পর্কের আত্নীয়। এ বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রী জানেন।
আড্ডার কথোপকথনের এক পর্যায়ে বিতর্কিতদের বাদ দেয়ার পক্রিয়া এবং পদবঞ্চিত বিদ্রোহীদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার মনোভাব কি এমন প্রশ্ন ছুড়ে দেন এ প্রতিবেদক। তখন তারা আবারো বলতে শুরু করেন, ওবায়দুল কাদের দীর্ঘ ৭০ দিন চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আবারো কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। গণমাধ্যমে তিনি ছাত্রলীগের সমস্যা সমাধান হবে বলেও একবার মন্তব্য করেছেন। কিন্তু এরপরদিনই ভোরের পাতার প্রতিবেদককেই নাকি ফোন ব্যাক করে জানিয়েছেন, ‘ছাত্রলীগ নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যাথা নেই। এটা জাহাঙ্গীর কবির নানকের বিষয়। তবে সমস্যা সমাধানে আপা (শেখ হাসিনা) আমাকে দায়িত্ব দিলে তা অবশ্যই নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে পালন করে দেখাবো।’ এরপর কিন্তু তিনি বসে নেই। সমস্যা সমাধানের জন্য যেন তাকে বলা হয় সেই কারণে পদবঞ্চিতদের আন্দোলনে পেছন থেকে তার নিজস্ব লোক (ছাত্রলীগের পেছনের সারির কিন্তু কর্মীবান্ধব একজন সাবেক নেতা, যিনি এমপি নির্বাচন করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে উপজেলাতেও ফরম তুলেছিলেন, সেখানেও ব্যর্থ হয়েছেন; তবে তিনি ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির শীর্ষ এক নেতার ঘনিষ্ঠ এবং তার নিজস্ব একটি কর্মী বাহিনী রয়েছে ছাত্রলীগের মধ্যেই, যাদের তিনি নিয়মিত পৃষ্ঠপোষকতা করেন) দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। আন্দোলনকারী অনেকেই গোপন এই বার্তার কথা স্বীকার করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্রে প্রধানমন্ত্রী অবহিত হয়েছেন। এই আন্দোলনকারীদের মূল পৃষ্ঠপোষক ওবায়দুল কাদের, তাই এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না বা বিতর্কিতদের বাদ দিতে এত দেরি হচ্ছে।
কথায় কথায় আরো উঠে আসে, সম্প্রতি জাহাঙ্গীর কবির নানকের একটি মন্তব্যের বিষয়টি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে গণমাধ্যমটিকে সচেতনভাবে এড়িয়ে চলেন, সেই গণমাধ্যমে জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, ‘পদবঞ্চিতরা ছাত্রলীগের কেউ নন।’ এই কথাটিকে পুঁজি করে আন্দোলন আরো গতিশীল করার মেসেজও দেয়া হয়েছে ওবায়দুল কাদেরর ঘনিষ্ঠজনদের মাধ্যমে। তাই সমস্যা সমাধানের জন্য এখন ওবায়দুল কাদের এবং জাহাঙ্গীর কবির নানকের স্নায়ুযুদ্ধটা প্রকাশ্যেই চলে আসছে। এক্ষেত্রে ছাত্রলীগের সমস্যা যতদিন বাড়িয়ে রাখা যাবে, ততদিনই নানক ব্যর্থ হবেন। আর সেই সুযোগে ওবায়দুল কাদের বলতে পারবেন, দীর্ঘ সময় পরও দায়িত্বপ্রাপ্তরা সমাধান করতে না পারায় আপা (শেখ হাসিনা) আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। এই সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন ওবায়দুল কাদের।
প্রায় ২৫ মিনিটের আড্ডা শেষে, ছাত্রলীগের চলমান সংকট নিরসনে এখনো জাহাঙ্গীর কবির নানক অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডয়াম সদস্য। তারা মনে করেন, এত বড় সংগঠনে বিতর্কিতরা আসতেই পারে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে সেই কলংকমুক্তি থেকে দায়ও পেতে পারেন নানক। তবে সেটা দ্রুতই করতে হবে। কেননা সময় যত গড়াবে ততই জল ঘোলা হবে, আর সেই সুযোগে ওবায়দুল কাদের খেলাটা নিজের হাতে নিয়ে নিবেন। আর সেটি করতে পারলে আগামী আওয়ামী লীগ সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে নেত্রীর কাছে আস্থাশীল হতে আরো একধাপ এগিয়ে যাবেন। আর যদি নানক, রহমান, মোজ্জামেল, নাসিম মিলে সমস্যার সমাধান করতে পারেন; তাহলে তারাও এগিয়ে থাকবেন সম্মেলনে মূল্যায়িত হওয়ার বিষয়ে। যদিও দায়িত্বপ্রাপ্ত ৪ নেতার মধ্যেই আস্থাহীনতা রয়েছে। একজন বেশি লোক বসিয়েছেন, আরেকজন কম ভাগে পেয়েছেন ছাত্রলীগের কমিটিতে তা নিয়েও মনোমালিণ্য রয়েছে।
তবে শেষ কথা হিসাবে শেখ হাসিনার ছাত্রলীগকে আর বলির পাঠা না বানিয়ে কলংকমুক্ত ছাত্রলীগ গড়তে নেত্রী যে আল্টিমেটাম দিয়েছেন ২ দিনের সেটি শুক্রবার শেষ হবে। তার আগেই সমস্যার সমাধান হলে সবার জন্যই মঙ্গল। যদিও এটা করতে পারলে জাহাঙ্গীর কবির নানক অনেক দূর এগিয়ে যাবেন। আর ব্যর্থ হলে আবারো ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা হিসাবেও রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের নতুন একটি কলংকতিলক যোগ হবে। হয়তো ভবিষ্যতে রাজনীতি করবেন কিন্তু পার্টি ফোরামে কথা বলারও সুযোগ কম পাবেন। ছাত্রলীগের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হলে কিভাবে আওয়ামী লীগের মতো মূল সংগঠনে যাবেন তা নিয়েও প্রশ্ন তুলে আডডার পরিসমাপ্তি ঘটে।
বের হতে হতে একটা কথাই বলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য, শেখ হাসিনার প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের ও জাহাঙ্গীর কবির নানক বহু আগেই উর্ত্তীণ হয়েছেন। এখন তাদের সামনে ছাত্রলীগকে কলংকমুক্তির চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চাইলে তারা দুজনই একসঙ্গে বসে সেটা সমাধান করতে পারেন। নেত্রীর অনেক কাজ থাকে, তাকে ছাত্রলীগ নিয়ে এত ভাবনা না দিয়ে নিজেরা মিলে গেলেই কলংকমুক্ত ছাত্রলীগ পাওয়া সম্ভব। সেক্ষেত্রে আব্দুর রহমানকে না রাখলেও চলবে। কারণ তার ওপর প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট বিরক্ত হয়েই গত নির্বাচনে মনোনয়ন দেননি। তার আসনে একজন সাবেক আমলা যিনি খালেদা জিয়ার দুর্নীতি মামলায় প্রয়োজনীয় নথি দিয়ে সত্য প্রকাশে আদালতকে সহায়তা করেছেন তাকে নৌকার মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল এবং তিনি জিতেও এসেছেন। ছাত্রলীগকে নিয়ে আব্দুর রহমানের এত নিবিড়ভাবে লেগে থেকে বিতর্কিতদের পদায়নের বিষয়েও প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
গাড়িতে উঠতে উঠতে তিনি বলে গেছেন, আমরা যারা আওয়ামী লীগ করি তারা সবাই কলংকমুক্ত ছাত্রলীগই চাই। কারণ ছাত্রলীগের বদমান মানে শেখ হাসিনার বদনাম। এটা যারা বিশ্বাস করেন না, তারা আসলে কি চান সেটা সময়ই বলে দিবে। শেখ হাসিনার প্রশ্নে আপোসহীনতা শুধু মুখে বললেই হবে না, কাজ দিয়েই তা প্রমাণ করতে হবে। ছাত্রলীগের এই সমস্যা সমাধান খুব দ্রুতই হবে এই আশা প্রকাশ করে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লেগান শুনিয়ে প্রতিবেদককে বিদায় জানান তিনি।