অবৈধ টাকায় ‘মানবতার ভণ্ডামি’ করছেন এমপি জগলুল হায়দার!

  • ১৮-Jun-২০১৯ ০৩:৪৮ অপরাহ্ন
Ads

:: উৎপল দাস ::

একজন সংসদ সদস্য হয়েও শুধু আলোচনায় থাকার জন্য পরিমিতিবোধ হারিয়ে নিজেকে হাস্যকর বানিয়েছেন সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য এস এম জগলুল হায়দার। এমপিদের মধ্যে সবচেয়ে মানবিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যর্থ চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন তিনি। সব সময়ই কথিত মানবিক কাজ করে তিনি আলোচনায় থাকতে চান। মূলত, অবৈধ আয় দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন মানবতার নামে এসব লোক দেখানো (ভ-ামী) কার্যক্রম। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এরকম তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে। জগলুল হায়দারের নানা দুর্নীতি, অপকর্ম নিয়ে ভোরের পাতার ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব।

একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে তিনি হলফনামায় উল্লেখ করেছেন, ব্যাংকে তার কোনো টাকা নেই। তবে তার কাছে নগদ ৩৭ লাখ টাকা আর স্ত্রীর কাছে ২০ লাখ টাকা রয়েছে। তার নামে তিনটি মামলা। সব মামলাতেই অব্যাহতি পেয়েছেন তিনি। বাৎসরিক হিসেবে কৃষিখাত থেকে আয় দুই লাখ টাকা, ব্যবসা থেকে আয় ১৯ লাখ ৯৫ হাজার টাকা, পরিতোষিক আয় ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা ও সম্মানীভাতা এক লাখ ৭৭ হাজার ৯৯৫ টাকা। হলফনামায় তিনি দুটি মোটরগাড়ি, স্ত্রীর ৪ লাখ টাকা মূল্যের ১০ ভরি স্বর্ণ, দেড় লাখ টাকার ইলেকট্রিকসামগ্রী, ৩ লাখ টাকার আসবাবপত্র, ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকার পিস্তল-শর্টগান রয়েছে বলেও উল্লেখ করেছেন। তার ৬৪ লাখ টাকার ৫.১৭ শতক কৃষিজমি, ৪১ লাখ টাকার অকৃষি জমি, ১৪ লাখ টাকার দুই তলা বাড়ি, সরকারি বরাদ্দে অ্যাপার্টমেন্ট ৩৫ লাখ ৬৯ হাজার ৬০০ টাকার, ২০ লাখ টাকা শেয়ারে চারটি মাছের ঘের ও সরকার কর্তৃক বরাদ্দ করা ৬ লাখ টাকার প্লট রয়েছে। কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণ নেই এস এম জগলুল হায়দারের।

তবে স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করে ভোরের পাতার এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘যদি এমপি সাহেবের আয়ের পরিমাণ এত কম টাকা হয়। তাহলে তিনি কিভাবে প্রতিদিনই মানুষকে টাকা বিলিয়ে বেড়াচ্ছেন। লোক দেখানো মানবিকতা দেখানোর মাধ্যমে জগলুল হায়দার প্রকৃতপক্ষে ভন্ডামি করে বেড়াচ্ছেন। কাউকে উপকার করলে তা গোপনে করতে হয়। তিনি কারও বাড়িতে গভীর রাতে বাজার করে নিয়ে যাচ্ছেন, রাস্তাঘাটে রিকশাচালক বা পাগলের জন্য নিজের পাঞ্জাবি খুলে দিয়ে দিচ্ছেন। এক পরিবারকে সাহায্য করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও করে ছেড়ে দিচ্ছেন। আর তার আশপাশের লোক তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন, আর বলে বেড়াচ্ছেন ‘মানবিক এমপি জগলুল হায়দার।’ 

একটি উদাহরণ টেনে সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা বলেন, ‘জগলুল হায়দার নিজের এলাকার মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্য নন। যোগ্য নেতৃত্ব এতদিন গড়ে ওঠেনি বলেই আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে তিনি এসব ভ-ামি করে যাচ্ছেন। এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। কারণ আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নষ্ট করার অধিকার তার নেই। জগলুল হায়দার যে কারণে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি করছেন, তা আজ সাতক্ষীরাবাসীর কাছে প্রমাণিত। কেননা, তিনি বছরে আয় করেন মাত্র ২০ লাখ টাকা এভাবে দাবি করলেও প্রকৃত পক্ষে তার আয় ১০ কোটি টাকারও বেশি। তদবির, টেন্ডার, ঘুষ, কমিশন, চাকরি বাণিজ্য থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি করে আয় করা এই টাকাগুলো হালাল করতেই এসব কার্যক্রম চালাচ্ছেন। কেননা, তিনি প্রতিমাসে যদি ৫ লাখ টাকার মানবিক কাজ করে থাকেন তখন তা বছর শেষে ৬০ লাখ টাকা হওয়ার কথা। তিনি যা আয় করেন তার থেকে তিনগুণ বেশি। এত টাকা তিনি কোথা থেকে আয় করেন, তা সাতক্ষীরার মানুষ জানে। নিজের ঘনিষ্ঠ আতœীয়ের মাধ্যমে তিনি এই অবৈধ টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছেন।’ 

জগলুল হায়দারের ঘনিষ্ঠ ওই আত্মীয় জানিয়েছেন, আমার এমপি সাহেবের অনেক টাকা। কয়েকদিন পর পর তিনি দেশের বাইরে বিশেষ করে কলকাতায় যাচ্ছেন। সেখানে আমাকে প্রচুর টাকা পাঠাতে হয়। কথিত রয়েছে, জগলুল হায়দার কলকাতায় প্রচুর ধনসম্পদ গড়েছেন। যদিও সরাসরি কলকাতায় বাড়ির কথা স্বীকার করেননি জগলুলের অবৈধ টাকা লেনদেন করা বেসরকারি ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা। জগলুল হায়দারও বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জগলুল হায়দার বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে নিয়মিত ভারতে যাতায়াত করেন। 

এলাকাবাসী আরও জানিয়েছে, জগলুল হায়দার যদি এত কম সম্পদের মালিক হন; তাহলে আমরা তাকে টাকা দেবো। কিন্তু তাকে সংসদ সদস্য হিসাবে যতটুকু দায়িত্ব ততটুকু তা পালন করলেই হবে। জানা গেছে, তিনি ঢাকায় নিজের বাসা থেকে শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণের জন্য ৫ টি কম্বল নিয়ে টিএসসিতে ঘুরে ৩টা কম্বল নিয়ে বাসা ফেরত আসেন। যদিও সাংবাদিকদের একটি অংক বরাদ্দ দিয়ে কম্বল বিতরণের সংবাদ প্রকাশ করিয়েছেন। শ্যামনগর ও কালীগঞ্জের একাংশ এলাকার অধিকাংশ মানুষ তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এমপির কাজ এমপি করবেন। তার কাজ আইনপ্রণয়ন করা। তিনি এলাকার মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থাকবেন। তিনি এলাকার মানুষের সাথে লোক দেখানো কার্যক্রম করে ধরা খেয়ে এখন অন্য জায়গায় গিয়ে এসব করে বেড়াচ্ছেন। ফলে তার কার্যক্রমে স্থানীয়রা লজ্জাবোধ করেন।’

উল্লেখ্য, সুন্দরবনে প্রবেশে প্রতিটি ট্রলার থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা আদায় করেন জগলুল হায়দার, এছাড়া তার পরিবারের লোকজন চাকরির তদবির, ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায় করার অভিযোগ রয়েছে। এই অংক মাসে ১ কোটি টাকার ওপরে বলে দাবি করেছে জগলুলের ঘনিষ্ঠ এক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনিই জগলুলকে নির্বাচনের সময় ৫০ লাখ টাকা দিয়ে মনোনয়ন পেয়েছিলেন বলে জানা গেছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে ফোন করলে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তার ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে এর আগে দুই পর্বের অপকর্মের উপাখ্যানের বিষয়ে জানতে চাইলে বারবার জগলুল হায়দার উত্তেজিত হয়ে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিয়ে ফোন কেটে দেন। তিনি ভোরের পাতার প্রতিবেদক সম্পর্কেও বিভিন্ন মহলে বিচার দিচ্ছেন, যদিও সবাই তাকে গণমাধ্যমের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

Ads
Ads