দ্রব্যমূল্যে বাজেট প্রভাব: অসৎ ব্যবসায়ীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে কেন?

  • ২৩-Jun-২০১৯ ০৪:১৫ পূর্বাহ্ণ
Ads

 

:: ড. কাজী এরতেজা হাসান ::

আমাদের দেশে বাজেট পাস পূর্ব একটা বাজার সংস্কৃতি রয়েছে, যা কখনোই অন্যথা হওয়ার নয়। আর সেটা হচ্ছে বাজেট পেশকালে যেসব পণ্য বা জিনিসের দাম বাড়বে বলে একটা আগাম ধারণা দেওয়া হয়ে থাকে সেটা পাসের আগেই বাজারে প্রভাব পড়ে যাওয়া। শুধু তাই নয়, বাজেট পেশের আগেই যদি ধারণা পাওয়া যায় যে, অমুক-তমুক পণ্যের দাম বাড়ছে, তাহলে সেই বাজেট পেশের আগেই সেসব পণ্য সহজে আর বাজারে না ছাড়া বা ছাড়লেও তার বাড়তি দাম ধরাই একটা স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে যাওয়া। আর এটা সম্ভবত বাংলাদেশ বলেই সম্ভব। যেমন,  ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে বেশকিছু পণ্যের ওপর নতুন করে ভ্যাট ও শুল্কারোপের প্রস্তাব আনা হয়েছে। কিন্তু আমরা এখানে দেখছি যে, যেখানে সিদ্ধান্ত কার্যকরই হয়নি সেখানে ব্যবসায়ীরা এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ইতোমধ্যেই দাম বেড়েছে গুঁড়া দুধসহ বেশকিছু পণ্যের। বিক্রেতারা দাবি করছেন, কোম্পানিগুলো দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় তাদেরকে বাধ্য হয়ে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। বাজারে ১ কেজি ওজনের গুঁড়া দুধ বিক্রি হচ্ছে ৬১০ টাকায়। আগে যার দাম ছিল ৫৯০ টাকা। চিনির দাম মণপ্রতি বেড়েছে ১২০ টাকা। চিনির পাশাপাশি ভোজ্যতেলের দামও মণপ্রতি ৯০ টাকা বেড়েছে। 

প্রস্তাবিত বাজেট, আমদানিকৃত অপরিশোধিত চিনির শুল্ক টনপ্রতি ২ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার টাকা, পরিশোধিত চিনির শুল্ক সাড়ে ৪ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৬ হাজার ও সম্পূরক শুল্ক (আরডি) ২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। কিন্তু বাজেট পাস হওয়ার আগেই প্রস্তাবিত বাজেটের সুপারিশ অনুযায়ী পণ্যের দাম বাড়ানোয় সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ক্রেতাদের অভিযোগ, বাজেট পাস হওয়ার আগেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ ভোক্তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। এরকম অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে শুধু নিম্নবিত্ত নয়, সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের কষ্ট বাড়বে। আমরা মনে করি, সাধারণ মানুষকে এমন হয়রানি থেকে রক্ষা করতে সরকারের বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। যদিও সরকার সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কাছে একপ্রকার নিরূপায় বলেই মনে হয়। নয়তো ব্যবসায়ীরা কী করে বাজেট পাস হওয়ার আগেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে সরকারের নাকের ডগায় বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিতে পারছে?

আমরা দেখছি যে, ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সিন্ডিকেটের আধিপত্য এক প্রকার অপ্রতিরোধ্যই বলা চলে। যদিও এটা নতুন কিছু নয়, বরং এটা একপ্রকার সাংবার্ষিক বিষয়েই পরিণত হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্য তো বটে, সেবা খাতেও সিন্ডিকেটের হস্তক্ষেপ অপ্রতিরোধ্য। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, এদের ওপর মূলত রাজনৈতিক ছত্রছায়া দ্বারা সুরক্ষিত। ফলে এরা নিজস্ব মনমর্জিমতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। আর এভাবেই অনায়াসে অন্যায্যভাবে বিপুল মুনাফা লুটে নিতে পারছে। ব্যবসায়ীদের এই অসৎ প্রকৃতি বছরে দুবার দেখা যায়। এক হচ্ছে রমজান মাসে আরেক হচ্ছে বাজেট প্রণয়নকালে। এ অবস্থায় আমরা মনে করি, শুধু দিন বদল করলেই চলবে না, ডিজিটালাইজড হলেই হবে না, বরং বাজার পরিস্থিতি পাল্টানোর জন্য সবার আগে প্রয়োজন বিক্রেতাদের অসৎ, লোভী ও প্রতারণামূলক মানসিকতা বদলানো। যতোদিন না এটা বদলানো হচ্ছে, ততোদিন এই অসৎ প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে।

কিন্তু এটা ব্যবসায়ীরা স্বেচ্ছায় বদলাবে সে আশায় নিষ্ক্রিয়ভাবে বসে থাকলে চলবে না, এর জন্য রাষ্ট্র-সমাজের সচেতন দায়িত্বশীল মহলকেও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। কিন্তু সেখানেও যদি এই অসৎ ব্যবসায়ীরা জেঁকে বসে থাকে তাহলে কী হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, সেখানেও আমরা দেখি এই ব্যবসায়ীদেরই দাপট। সংসদেও এই ব্যবসায়ীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর রাজনীতিকরা সংখ্যালঘু। তাহলে কী হবে। আমরা কি তবে ততোদিন পর্যন্ত স্যামুয়েল বেকেটের একজন ‘গডো’র অপেক্ষায় বসে থাকব?
 

Ads
Ads