শোভন-রাব্বানীর ছাত্রলীগকে কলংকিত করতে ওরা তিনজনই যথেষ্ট!

- ২৪-Jun-২০১৯ ১০:১২ পূর্বাহ্ণ
উৎপল দাস
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই ছাত্রলীগের সর্বোচ্চ অভিভাবক। মূল সংগঠনের একমাত্র ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনটিকে কালো অদৃশ্য সিন্ডিকেটমুক্ত ও বিতর্কহীন করতে শেখ হাসিনা নিজেই বারবার উদ্যোগী হয়েছেন। তারপরও শেখ হাসিনার প্রাণের ও আবেগের সংগঠন ছাত্রলীগে সক্রিয় হয়ে উঠেছে নতুন এক অনৈতিক সিন্ডিকেট। ভোরের পাতার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমনই এক নতুন সিন্ডিকেটের খবর, যে সিন্ডিকেট জেলা ও বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি নিয়ে বাণিজ্য করছে। বর্তমান কমিটির কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর নাম ভাঙিয়ে টাকার বিনিময়ে পদ পাইয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি, নারী কর্মীদের পদ দেয়ার জন্য অনৈতিক প্রস্তাব থেকে শুরু করে ছাত্রলীগকে নানাভাবে কলংকিত করছে তিনজনের এই সিন্ডিকেট।
সভাপতি শোভনের দিক থেকে ছাত্রলীগকে কলংকিত করার ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের মূল হোতা হিসাবে কাজ করছেন সোহাগ-নাজমুল কমিটির সাবেক আইন উপ সম্পাদক বিপ্লব হাসান পলাশ। রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে তিনি নিজে ছাত্রলীগের সভাপতি বানিয়েছেন এমন একটা প্রচারণা চালিয়ে আসছেন কমিটি হওয়ার শুরু থেকেই। সোহাগ-জাকিরের কমিটিতে পদবঞ্চিত হওয়াতে এই পলাশ নিজেকে এখন ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রক হিসাবে জাহির করতে ব্যস্ত সময় পার করেন। ছাত্রলীগের সভাপতি শোভনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে তিনি পূর্ণাঙ্গ কমিটি হওয়ার আগে অনেক নারী নেত্রীকে নিজের গোপন লাসলার শিকার বানাতে নানা ধরণের অনৈতিক প্রস্তাব দিয়েছেন। অনেকে পদ বাগিয়ে নিয়েছেন আবার অনেকে সরাসরি তাকে অপমানও করে দিয়েছেন। খোদ পদপ্রাপ্ত এবং পদ না পাওয়া দুইশ্রেণীর নারী নেত্রীদের সঙ্গেই কথা বলে বিষয়টির সত্যতা পাওয়া গেছে। এছাড়া ঘরে বউ রেখে এই বিপ্লব হাসান পলাশ ছাত্রলীগের সুন্দরী নারী নেত্রীদের মোবাইলে এসব কুপ্রস্তাব না দিয়ে হোয়াটস আপে এসে কথা বলার জন্য অনুনয় বিনয় করে। রেকর্ড হচ্ছে না ভেবে হোয়াটস আপে তখন তার সঙ্গে একান্তে সময় পার করার অফার দেন, এমনকি লং ড্রাইভে নিয়ে যাওয়ারও প্রলোভন দেখান এই বিপ্লব হাসান পলাশ।
শোভনের নাম কলংকিত করা এই বিপ্লব হাসান পলাশের বিরুদ্ধে সর্বশেষ অভিযোগ উঠেছে, কুষ্টিয়া ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের পক্রিয়াতে তার জড়িত থাকার কারণে। কুষ্টিয়া ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বরিউল ইসলাম পলাশ ইউনিটের একজন সভাপতি / সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী। বাড়ি কুড়িগ্রাম হওয়ায় শোভনের ঘনিষ্ঠজন হিসাবে পরিচিত বিপ্লব হাসান পলাশকে ইতিমধ্যে মোটা অংকের টাকা দিয়েছেন বলে দাবি করেছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। যদিও ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র রবিউল ইসলাম পলাশ (বর্তমানে আইইআরআর’এ অধ্যয়ণরত) তার সুন্দরী এক বান্ধবীকে দিয়েও বিপ্লব হাসান পলাশের সাথে লবিং করিয়েছেন বলে জানা গেছে। বিপ্লব হাসান পলাশের সাথে রবিউল ইসলাম পলাশের টাকা লেনদেনের বিষয়টি ভোরের পাতার কাছে সুস্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক পদপ্রার্থী মিজানুর রহমান লালনের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফের অনুসারী হিসাবে কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মিজানুর রহমান লালন নিজেকে শক্তিশালী প্রার্থী মনে করছেন এবং অন্যপ্রার্থীর বিরুদ্ধে টাকা লেনদেনের অভিযোগও তুলেছেন। তবে মিজানুর রহমান লালনের বিরুদ্ধেই নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে, কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিতর্কিত যারা ছাত্রলীগের শীর্ষপদের জন্য লবিং করছেন তাদের মধ্যে সাবেক কমিটির সদস্যপদ নিয়ে ঝামেলা থাকা রাকিবুল ইসলাম রাকিব। যদিও বিষয়টি নিয়ে ভোরের পাতার সঙ্গে সাবেক কমিটির সভাপতি সাইফুল ইসলাম এবং সাধারণ সম্পাদক অমিত কুমার দাস কথা বলেছেন। তারা দুজনেই নাম বিভ্রান্তির বিষয়টি পরিষ্কার করে বলেছেন, রাকিবুল ইসলাম রাকিবই তাদের কমিটির সদস্য ছিলেন। এছাড়া মাদকাসক্ত ও ইভটিজিংয়ের আসামিদের ছাড়িয়ে নেয়ার মতো গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মন্দির ভাঙার দায়ে ছাত্রলীগ থেকে বহিস্কৃত ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত এবং মামলার আসামি ও টেন্ডারবাজিতে জড়িত শিশির ইসলাম বাবু।
শোভনের ঘনিষ্ঠজন হিসাবে পরিচিত ছাত্রলীগের কথিত সিন্ডিকেটের মূল হোতাকে সহায়তা করতেও কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা কাজ করছেন বলে জানা গেছে। তবে এসব অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে বিভিন্ন সময় টেলিফোনালাপে বলেছেন একসময়ের পদবঞ্চিত হওয়ার বেদনাহত ছাত্রলীগের সাবেক নেতা পলাশ। তবে সেই বেদনাহত হওয়ার কারণেই ছাত্রলীগের ওপর নির্মম প্রতিশোধ নিতে গিয়ে সংগঠনের সম্মানহানি করছেন কিনা, সেটি খতিয়ে দেখারও সুযোগ রয়েছে বলে দাবি করেছেন অনেকে।
এছাড়া কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটিতে গোলাম রাব্বানীর পক্ষে হস্তক্ষেপ করছেন বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির উপ আন্তজার্তিক বিষয়ক সম্পাদক ফুয়াদ হাসান। কেন্দ্রীয় সভাপতি গোলাম রাব্বানীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় ৩১ বছর বয়সেও তিনি কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ পদটি বাগিয়ে নিয়েছেন। এছাড়া কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জুয়েল রানা হালিম কাছ থেকে টাকা নিয়ে কমিটি পূর্ণবহালের দেন দরবারও করছেন নিয়মিত। ফুয়াদের বিরুদ্ধে আরো একটি গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে রাজধানীর কয়েকটি ইউনিটের (কবি নজরুল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে ধার হিসাবে নিয়ে সেই টাকা না দেয়া। এমনকি ছাত্রলীগে বর্তমানে যারা বিদ্রোহী ও পদবঞ্চিত রয়েছে তাদের অনেকের বিরুদ্ধে লাগাতর বিষেদাগার করে গোলাম রাব্বানীর কান ভারী করেছেন এই ফুয়াদ হাসান। ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হওয়ার আগে থেকেই নিয়মিতভাবে গোলাম রাব্বানীকে ত্যাগী ও যোগ্য নেতাদের মাইনাস করতে নোংরা প্রচারণা চালিয়ে গেছেন। ফলে আজকের চলমান এই সংকটের পিছনে দায়ী বলতে এই ফুয়াদ হাসানই একজন অন্যতম হোতা হিসাবে কাজ করেছেন বলে মনে করেন খোদ ছাত্রলীগেরই একটি অংশ। কেননা শোভন-রাব্বানী যোগ্যদেরই মূল্যায়ণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে কান ভারি করে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অন্যদিকে প্রভাবিত করেছেন ফুয়াদ হাসান।
এসব অভিযোগের বিষয়ে ফুয়াদ হাসানকে সোমবার বিকাল সাড়ে ৩ টায় ফোন করা হলে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগই মিথ্যা। কোনো অভিযোগ তিনি স্বীকার না করলেও ছাত্রলীগ করার মতো বয়স তার নেই। কারণ তার বয়স ৩১ বছর। এরপর পর কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফুয়াদ হাসান নিজেই ফোন ব্যাক করে নিজেই অবস্থান ব্যক্ত করতে চান। তখন তার ছাত্রলীগ করার মতো বয়স রয়েছে কিনা এমন প্রশ্ন করা হলে আমতা আমতা করতে শুরু করেন। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে নিজের বয়স কত সেটা করতে পারেননি। হালিমের সঙ্গে তার সখ্যতার কথাও স্বীকার করেছেন কিন্তু টাকা গ্রহণের বিষয়টি অস্বীকার করেন। এমনকি ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর কান ভারি করার বিষয়টিও কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে ধার নিয়ে টাকা ফেরত না দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন ফুয়াদ। তবে ৪ জন ভুক্তভোগী নিজেই ভোরের পাতাকে বলেছেন, আমারা ছোট নেতা, তাই এসব নিয়ে কাউকে কিছু বলতে পারি না। রাব্বানী ভাইকেও আমরা বিষয়টা জানাতে চেয়েছি, কিন্তু ফুয়াদ হাসান রাব্বানী ভাইয়ের সাথে থাকে বলে আমরা ভয় পাই।
সর্বশেষ যে ব্যাক্তিটি ছাত্রলীগকে কলংকিত করছেন তিনি হচ্ছেন বর্তমান কমিটির প্রচার সম্পাদক শফিকুল আলম রেজা। তিনি পটুয়াখালী জেলা কমিটিতে নিজের পছন্দের লোকদের টাকার বিনিময়ে বসাতে না পেরে নির্ধারিত সময়ের পরও কমিটি প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না। চলতি মাসের ২০ তারিখই পিরোজপুর জেলা কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার কথা থাকলেও বিতর্কিত ও বিএনপি নেতার ছেলেকে কমিটিতে ঠাঁই দিতে না পারার কারণে সুকৌশলে কমিটি আটকে রেখেছেন শফিকুল আলম রেজা। বিএনপি নেতার ছেলের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা আগেই নিয়েছেন ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক। এখন কমিটিতে নাম ঢুকাতে না পেরে জেলা কমিটিই আটকে রেখেছেন তিনি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক শফিকুল আলম রেজাকে ভোরের পাতার অফিস থেকে ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এমনকি এ প্রতিবেদক তাকে একটি ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তিনি কোনো প্রতিউত্তর করেনন। তবে যতটুকু জানা গেছে, টাকা আগেই নিয়ে নেওয়ায় পিরোজপুর কমিটিতে পদ না দিতে পারার একটি সম্ভাবনা তৈরি হওয়াতে তিনি বেশ চাপেই রয়েছেন।
ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে কোথাও কেউ কোনো অনৈতিক কাজ করলে তিনি যতই শক্তিশালী বা ঘনিষ্ঠ হোক না কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কোনো কার্পণ্য থাকবে না বলে ভোরের পাতার এ প্রতিবেদককে বহু আগেই জানিয়েছেন সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন। তিনি বলেন, আমাদের ছাত্রলীগের পরিপূর্ণ গঠনতন্ত্রের নাম শেখ হাসিনা। তার আদর্শকে যারা প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, তাদের জন্য কোনো সতর্কবার্তা নয়, সরাসরি ব্যবস্থা নেয়া হবে। শেখ হাসিনার ছাত্রলীগে আর কোনো কলংক লাগতে দেয়া হবে না। আমার আপন ছোট ভাইও যদি কোনো অন্যায় করে তাকেও কোনো ছাড় দিবো না। আর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, তা খতিয়ে দেখে অব্যশই ব্যবস্থা নেব। কারণ ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শে, শেখ হাসিনার প্রশ্নে আপোসহীন সংগঠন। এই সংগঠনকে যারাই কলংকিত করতে চাইবে তাদের হাত গুড়িয়ে দেয়া হবে।
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীও বিভিন্ন সময় এ প্রতিবেদককে বলেছে, অনেকেই অভিযোগ করেন টাকা নিয়ে কমিটি দেয়ার। কিন্তু ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকে কোনো কমিটির জন্য এক টাকাও নিই নাই। কমিটি বাণিজ্যের মতো গর্হিত নিচু কাজ শেখ হাসিনার ছাত্রলীগের শীর্ষ কোনো নেতা করতে পারে না। কেউ সেই প্রমাণও দিতে পারবেন না। যদি আমাদের কমিটির কেউ এমন কাজ করে থাকে, তাহলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে অবশ্যই কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। কারণ শেখ হাসিনা আমাদের হাতে পবিত্র দায়িত্ব দিয়েছেন, সেই দায়িত্বই পালন করতে চাই সততা আর নিষ্ঠার সাথে।
তবে, এই নিউজ প্রকাশের কিছুক্ষণ পরই টনক নড়ে বিপ্লব হাসান পলাশের। বিকাল ৪ টা ৩৩ মিনিটে এ প্রতিবেদককে ফোন করে বলেন, আপনি আমার বক্তব্য দেননি কেন? প্রতিবেদক উত্তরে জানান, বিষয়গুলো নিয়ে টেলিফোনালাপের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদকের কাছে তখন তিনি এসব অভিযোগকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন। সে কথাগুলো নিউজের মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে বলেও জানান এ প্রতিবেদক। এরপর প্রতিবেকের সঙ্গে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে প্রমাণ চাইলে, প্রমাণ ছাড়া নিউজ লিখি নাই বলে এ প্রতিবেদক নিজেই ফোন কেটে দেন।