অপশক্তির বাঁধা উপেক্ষা করেই গৌরবের ১৫ বছরে দৈনিক ভোরের পাতার পদার্পণ

- ৩-Jul-২০১৯ ০৪:৪৫ পূর্বাহ্ণ
:: ড. কাজী এরতেজা হাসান ::
শৈশবের স্মৃতিচারণে ভাসি প্রায়শই। ভেসে যেয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করি। আমি কে, কোথা থেকে এলাম? যান্ত্রিকতার মধ্যে দানব না হয়ে ঘুরেফিরে চলে যাই সেই মহান সৃষ্টিকর্তার কাছেই। রাব্বুল আলামিন ভালোই রেখেছেন আমাকে। বিনিময়ে তার জন্য কী করতে পেরেছি? এমন মৌলিক জিজ্ঞাসায় মনে মনে ভেবে থাকি, মানুষ হতে পেরেছি তো?
মধ্যবিত্ত ঘরের সরকারি চাকুরিজীবী পিতা কাজী আবদুল মান্নান ও মা আজিজা খাতুনের সন্তান হিসেবে এই পৃথিবীতে এসেছিলাম। তাঁরা আমাকে জ্ঞান দিয়েছেন, মানুষ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা আজ অবধি দিয়ে যাচ্ছেন। জানালা ছুঁয়ে আকাশ দেখার সুযোগ হয় না, তা নয় কিন্তু। দেখি মাঝে মাঝে। প্রকৃতির মাঝে খুঁজি প্রিয় আল্লাহকে, মায়ের কণ্ঠে সত্য ও সুন্দরের সুর শুনি জীবনের প্রতিটা ক্ষণে। মা যখন বাদ্যযন্ত্রহীন কথার সুরে গেয়ে ওঠে, তখন মনে হয় কজন সন্তানের এমন উপলক্ষ পরখ করার সুযোগ মেলে? স্রষ্টাও তখন বলে, এরতেজা এগিয়ে যাও...
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে মিনি পাকিস্তান বলে যারা কটাক্ষ করে সেই সাতক্ষীরাতে হাতেগোনা যে কয়েকটি পরিবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, তার মধ্যে আমার পরিবার অন্যতম। সেই ছোটকাল থেকেই মায়ের মুখে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তেজোদীপ্ত ভাষণের গল্প শুনে শুনেই বড় হয়েছি। সেই থেকে শুরু। বঙ্গবন্ধুকে দেখি নাই। তবে তার আদর্শ, সংগ্রাম, নেতৃত্ব, কথা বলার অতি মানবিক ক্ষমতা আর ত্যাগের কথা শুনতে শুনতেই বড় হয়েছি। আর আজ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে খুব কাছ থেকে দেখতে দেখতে মুগ্ধ হচ্ছি প্রতিনিয়তই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে যতবার দেখি, ততবারই মুগ্ধতার রেশ আমার কাটতে চায় না। একজন ব্যক্তির মধ্যে নেতৃত্বের কতটা গুণাবলী না থাকলে এমন দৃষ্টান্তে যেতে পারেন! তিনিই এখন সারা বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের একমাত্র অর্থবহ যোগ্য প্রতিনিধি। খুব সহজ করে বললে, বিদেশের মাটিতে আমরা এখন গর্ব করে বলতে পারছি, এই জানো, আমরা কোন দেশের নাগরিক? শেখ হাসিনা হলো আমাদের নেতা। তখন তারাও আমাদেরকে মূল্যায়ন করে। ধর্মপ্রাণ এই মানুষটিকে দেখেই শিখেছি, কীভাবে সংগ্রাম করে স্রোতের বিপরীতে হেঁটে জয়ী হতে হয়। শেখ হাসিনাই এখন এমন একজন সত্তা, যিনি সারা বিশ্বের মুসলিম কমিউনিটিকে কিংবা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে আদর্শিক জায়গায় একত্র করে একাট্টা করলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একজন আদর্শিক সন্তান হিসাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী পরিবারের সদস্য হিসাবে ২০০৫ সালের আজকের এই দিনে দৈনিক ভোরের পাতার সম্পাদক ও প্রকাশক হিসাবে খুব স্বল্প পরিসরে যাত্রা শুরু করেছিলাম। বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি হিসেবে কাজ করতে গিয়ে আমাকে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবু লড়াই চালিয়ে গিয়েছি। পত্রিকা কীভাবে চলছে, তা নিয়ে হিসাবের পাতায় মন দিই নাই। আল্লাহর নামে শুরু করে আজ অবধি চলছে তো। অন্তত সাহস করে বলতে পারি, ভোরের পাতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধু ও হাসিনা সরকারের জন্য এতটা ইতিবাচক সংবাদমাধ্যম হয়ে আদৃত- যা অন্য কোন গণমাধ্যম করে দেখাতে পারেনি। সকলেরই দ্বিমুখী চরিত্র থাকলেও একজন প্রকাশক হিসাবে আমি এই জায়গায় আপোষহীন ছিলাম। সম্পাদক হিসাবে সার্বজনীন তথা নিরপেক্ষ আদলে বসবাস করে প্রিয় বাংলাদেশের জন্য প্রতিবেদকদের অনুপ্রাণিত করেছি। তাঁদেরকে বলেছি, সত্যটা লিখতে হবে। এতে যা হবার হবে। তাই ভোরের পাতার জন্ম রাজনৈতিক অপশক্তির আমলে হলেও, টিকে থেকেছি ঝুঁকি নিয়েও। এমনকি সরকারি বিজ্ঞাপন তো দূরের কথা, পরিবার ও জীবনের সংকটও তৈরি হয়েছিল একসময়। সাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ওই অপশক্তির রক্তচোখকে উপেক্ষা করেই শেখ হাসিনার আদর্শিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থেকে সামাজিক- সাংস্কৃতিক লড়াই চালিয়ে গিয়েছি। এই লড়াই মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত চলবে। প্রয়োজনে রাজনৈতিকভাবেও মোকাবেলা করার মানসে যাব।
গত বছর বহুল সমালোচিত ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ বইটি ঘিরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননার পর আমিই এই দেশে মহামান্য উচ্চ আদালতে রিট করেছিলাম। এ ঘটনায়ও পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা আমার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে নানা ধরনের ক্ষতিসাধনের অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনাকে কেউ অপমান করলে তাকে আমি ছেড়ে কথা বলবো না। প্রয়োজনে আমার জীবন যাবে, তবু এই পথচলা বন্ধুর হলেও ঝুঁকি নিতে আমি বদ্ধপরিকর।
এই গ্রহে সকলের মৃত্যু অনিবার্য বাস্তবতা। একদিন আমাকেও চলে যেতে হবে। আমাদের দম্পতির একমাত্র সন্তান কাজী জার্জিস বিন এরতেজা হয়তো পিতাকে হারিয়ে সেও একদিন এতিম হতে পারে; কিন্তু তাতেও আমার এ লড়াই থামবে না। বিশুদ্ধ রক্তের পিতা মাতার সন্তান হিসাবে বলতেই পারি, যতদিন বেঁচে থাকবো ঠিক ততদিনই ভোরের পাতাকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের পক্ষে কাজ করে যাবো। যত বাঁধা বিপত্তি আসুন না কেন, আমি পিছু হটবো না। আদর্শিক লড়াই চালিয়ে যাবোই।
সাউথ ওয়ের্স্টান মিডিয়া গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসাবে দৈনিক ভোরের পাতার আজ জন্মদিন। আজ থেকে ১৫ বছর আগে যে ভোরের পাতাকে নিয়ে শুরু করেছিলাম, আমার কাছে সেই ভোরের পাতাই রয়েছে। দীর্ঘ এই পথ পাড়ি দিতে গিয়ে কখনোই মনে হয়নি, সময়টা খুব দীর্ঘ। আমার তো মনে হয়, এই তো দিন পনের আগে ভোরের পাতাকে নিয়ে আবেগের জায়গা থেকে কাজ শুরু করেছি। নদীর স্রোতের বহমান ধারার মতো সময় চলে গিয়েছে অনেকদিন। তবুও ভোরের পাতার প্রথম মাহেন্দ্রক্ষণে আপনাদের হাতে ভোরের পাতা তুলে দিতে পেরে নাশতার টেবিলে মাঝেমাঝে নস্টালজিক হই। চোখ দিয়ে অজান্তেই ক্ষণে ক্ষণে ক’ফোটা চোখের জল ঝরে পড়ে। মনে হয়, সুপ্রিয় সন্তান ‘জার্জিস’ এর মতো ভোরের পাতাও আমার আরেকটি সুসন্তান।
সময়ের খাতায় দীর্ঘ ১৫ বছর হলেও আপনাদের সবার সর্বাঙ্গীণ সহযোগিতা আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুপ্রেরণায় এতটুকু আসতে পেরেছি। সম্মানিত বিজ্ঞাপনদাতা ও ভোরের পাতার শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রতি সম্পাদক ও প্রকাশক হিসাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ভবিষ্যতেও ভোরের পাতার পাশেই থাকবেন এই প্রত্যাশায় আছি। কেননা দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করা আর আপোষহীন সাংবাদিকতার জন্য ভোরের পাতাকে আমার মৃত্যুর পরও মানুষ মনে রাখুক--- এমন প্রত্যাশায় কাটে আজকের অহোরাত্র। অপশক্তি যদি আমার ক্ষতি করেও ফেলে তখন আমার একমাত্র সন্তান কাজী জার্জিস বিন এরতেজা দায়িত্ব নিবে এই ভোরের পাতার। আমার উত্তরসূরী হিসাবে তার প্রতি আপনাদের স্নেহ, ভালোবাসা ও সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করি। কেননা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে এই দোয়া করি, দৈনিক ভোরের পাতাকে এগিয়ে নিতে এ দীর্ঘ পরিক্রমায় অনেক বাঁধা এসেছে। কিন্তু কখনোই হতাশ হইনি। ভবিষ্যতেও হতাশ হবো না। দুঃসময় আসতেই পারে, কিন্তু সাহস নিয়ে সেই সময় মোকাবেলা করে আবারো জয় বাংলা স্লোগানের মতো মহাকাব্যের শাণিত দ্রোহে জয় করবো বাংলাদেশের সবার হৃদয়কে। যারা নানা সময়ে ভোরের পাতার সমালোচনা করেন, তাদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা। কারণ সমালোচনা না থাকলে কাজ করার কোনো মানে হয় না।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ভোরের পাতা সবাইকে সাথে নিয়ে মূল ধারার সাংবাদিকতার উৎকর্ষে থেকে নতুনত্ব আনবে। এক্ষেত্রে আপনারা সবাই পাশে থাকবেন। পাঠকদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা, যারা আমাদের মূল চালিকা শক্তি। আপনাদের অনুপ্রেরণায় আমরা সবাইকে সাথে নিয়ে ভোরের পাতাকে আগামী দিনে দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিকে পরিণত করবো। এই স্বপ্নের কথা বলেই আজকের মতো বিদায় নিচ্ছি। আবারো লিখতে চাই, আরো অনেক দিন লিখতে চাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ হয়ে। জানাতে চাই বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের তাৎক্ষণিক খবর সমাচার। আমাদের অনলাইন ভার্সন সেরা কিছু করতে চায়। এছাড়াও নিকট সময়ের মধ্যে গবেষণা আঙ্গিকে ভোরের পাতা প্রিয় বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক- সাংস্কৃতিক বৃত্তান্ত তুলে ধরবে প্রত্যেক সপ্তাহের একটি বিশেষ দিনে। আপনারা সবাই ভোরের পাতার জন্য দোয়া করবেন।
লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক ভোরের পাতা।বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য ও ধর্ম বিষয়ক উপকমিটির সদস্য।