কে হবে বিশ্বসেরা, ইংলিশ না কিউই?

- ১৪-Jul-২০১৯ ০৬:১৫ পূর্বাহ্ণ
:: স্পোর্টস ডেস্ক ::
ক্রিকেট বিশ্বকাপের ১২তম আসরের পর্দা নামছে রোববার (১৪ জুলাই)। লন্ডনের লর্ডসে অনুষ্ঠিত ফাইনাল দিয়ে শেষ হচ্ছে বিশ্বকাপের ৪৬ দিনব্যাপী আসর। স্বাগতিক ইংল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার ফাইনাল দিয়ে ইতি হচ্ছে এবারের বিশ্বকাপের। ২৭ বছর পর বিশ্বকাপের ফাইনালে ক্রিকেটের জনক ইংলিশরা। আর টানা দ্বিতীয়বার ফাইনালে কিউইরা।
কার আক্ষেপ ঘুচাবে এ বিশ্বকাপ? ইংল্যান্ড না নিউজিল্যান্ডের। তবে এটা ঠিক, এবার নতুন চ্যাম্পিয়ন পাচ্ছে আইসিসি। লর্ডসের ফাইনালে যে জয় পাবে, সে দল নতুন প্রথমবারের মতো শিরোপা অর্জন করার গৌরব অর্জন করবে। বাংলাদেশ সময় দুপুর সাড়ে ৩টায় শুরু হবে ম্যাচটি।
টুর্নামেন্টের ইতিহাসে ফাইনালে প্রথমবার মুখোমুখি হচ্ছে ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড। এর আগে বিশ্বকাপের মঞ্চে ইংলিশরা নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৯ বার মুখোমুখি হয়েছে। যার মধ্যে ৫ বার জিতেছে নিউজিল্যান্ড ও ৪ বার ম্যাচ জিতেছে ইংল্যান্ড।
আইসিসির প্রকাশিত সবশেষ র্যাংকিংয়ে ১২৩ রেটিং পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে ইংলিশরা। বিশ্বকাপের আগে থেকেই র্যাংকিংয়ের শীর্ষ স্থানেই ছিল ইংলিশরা। বিশ্বকাপ চলাকালীন পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হেরে ভারতের কাছে শীর্ষ স্থান হাতছাড়া করে ইংল্যান্ড। এরপর ভারতের বিপক্ষে জয় দিয়ে আইসিসির র্যাংকিংয়ে আবারও শীর্ষ স্থান পুনঃদখল করে মরগানরা। অন্যদিকে ১১৩ রেটিং পয়েন্ট নিয়ে তালিকার তিনে অবস্থান করছে নিউজিল্যান্ড।
তবে ম্যাচটি যখন বিশ্বকাপের ফাইনাল তখন রেটিং পয়েন্ট কিংবা র্যাংকিংয়ের অবস্থান দিয়ে ম্যাচের গুরুত্ব বোঝানো যাবে না। ম্যাচের উত্তাপের দেখা মিলবে কেবল খেলার ময়দানেই। যেখানে সমানে সমান লড়াই করতে প্রস্তুত দুই দল। বিশ্বকাপের মঞ্চে ইংলিশদের বিপক্ষের লড়াইয়ে কিছুটা এগিয়ে কিউইরা। বিশ্বকাপে দুই দলের ৯ দেখায় ব্ল্যাক ক্যাপসরা জিতেছে পাঁচ ম্যাচ অন্যদিকে ইংল্যান্ডের জয় চারটিতে। আর এবারের বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে দু’দলের ম্যাচে কিউইদের ১১৯ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়েছিল ইংলিশরা।
শক্তিশালী ভারতকে সেমি ফাইনালের রিজার্ভ-ডে’তে ১৮ রানের ব্যবধানে হারিয়ে ফাইনাল নিশ্চিত করে নিউজিল্যান্ড আর বর্তমান চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে ৮ উইকেটের ব্যবধানে হারিয়ে ফাইনালে উঠে আসে ইংলিশরা।
ফাইনালের আগে দু’দলই আছে দারুণ ফর্মে। কিউই এবং থ্রি লায়ন্স দুই দলের পেসাররা আছেন দারুণ ফর্মে। আর ইংলিশদের টপঅর্ডার এবং নিউজিল্যান্ডের মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানরাও আছেন সেরা ফর্মে। অপেক্ষার পালা প্রথমবারের মতো শিরোপা ঘরে তুলবে কোন দল। স্বাগতিক ইংলিশরা নাকি ধারাবাহিক কিউইরা।
লর্ডস নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সাদা চকচকে একটি মিডিয়া বক্সের ছবি। আর সবুজ ঘাসে মোড়ানো মাঠ। ক্রিকেটের মক্কা নামে পরিচিত ইংল্যান্ডের লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড। পৃথিবীর সব থেকে পুরাতন ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মধ্যে এটি অন্যতম। বয়স প্রায় ২০৫ বছর। ইতিহাস ঐতিহ্য সব দিক দিয়েই ক্রিকেট বিশ্বে লর্ডস সমাদৃত। সাক্ষী হয়ে আছে বহু স্মরণীয় ক্রিকেট ইতিহাসের মুহূর্তের। প্রায় ২৮ হাজার ধারণ ক্ষমতার এই স্টেডিয়ামটি নির্মিত হয়েছিল ১৮১৪ সালে। ২০১৪ সালে ক্রিকেটের মক্কা ২০০ বছরে পদার্পন করে। আর এই দুইশত বছরে লর্ডসের বুকে অনুষ্ঠিত হয়েছে ক্রিকেটের সব থেকে পুরাতন সংস্করণ টেস্টের ১০৫টি ম্যাচ।
১৮৮৪ সালের ২১ জুলাই ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ দিয়ে এ মাঠের যাত্রা শুরু। এরপর একে একে ১০৫টি টেস্ট ক্রিকেটের সাক্ষী হয়েছে। যার শেষটি ২০১৮ সালের ১০ আগস্ট ভারতের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের ম্যাচ। ওয়ানডে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আসার পর ১৯৭২ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ইংল্যান্ডের প্রথম ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হয় এই মাঠে।
বিশ্বসেরা আসরে এক দল সেমিফাইনালে গিয়ে হারবে, অন্য দল ফাইনালে৷ এই যেন তাঁদের ক্রিকেট নিয়তি৷প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের হাতছানি দুই দলেরই সামনে৷ আর ক্রিকেটবিশ্বও তো ১৯৯৬ সালের শ্রীলঙ্কার পর পেতে যাচ্ছে আনকোরা চ্যাম্পিয়ন৷ হয় ইংল্যান্ড, নয় নিউজিল্যান্ড৷
কিউইদের গায়ে ‘সেমিফাইনালের দল-এর তকমা এমনি এমনি লাগেনি৷ ১৯৭৫ সালে প্রথম বিশ্বকাপেই শেষ চারে জায়গা করে নেয় তাঁরা, চার বছর পরও৷ ১৯৮৩ ও ১৯৮৭ আসরে পারেনি, তবে ১৯৯২ টুর্নামেন্টে প্রবল দাপটে পেরেছে আবার৷ এরপর ১৯৯৯, ২০০৭ ও ২০১১ সালে আরো তিনবার৷ অর্থাৎ বিশ্বকাপের প্রথম ১০ আসরের মধ্যে ছয়বারই সেমিফাইনাল খেলে নিউজিল্যান্ড, এবং হারে প্রত্যেকটিতেই৷
২০১৫ সালে অবশেষে সপ্তম চেষ্টায় আনন্দের সপ্তমস্বর্গে কিউইরা৷ ওঠে ফাইনালে৷ কিন্তু হাসতে পারেনি শেষ হাসি৷ অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে রানার্সআপ ট্রফিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়ে তাঁদের৷ এবার শিরোপার শেষ মহারণে টানা দ্বিতীয়বারের মতো৷ এবারও যদি হেরে যায়, তাহলে ‘সেমিফাইনালের দল' নিউজিল্যান্ড একধাপ এগিয়ে ফাইনালের দল হিসেবে চিত্রিত হবে বড়জোর৷ সেটি নিশ্চিতভাবেই চায় না কেন উইলিয়ামসনের দল৷ পূর্বসুরীদের দায়মোচনে সুযোগটাও লর্ডসে হাতছাড়া করতে চাইবেন না কিছুতেই৷
দায় তো ইংল্যান্ডেরও কম নয়৷ ক্রিকেট খেলাটির আবিষ্কারক তাঁরা৷ প্রথম পাঁচ বিশ্বকাপের মধ্যে তিন-তিনবার ফাইনালও খেলেছে৷ অথচ ১৯৭৯, ১৯৮৭ ও ১৯৯২ সালের প্রতিটি চূড়ান্ত লড়াইয়ে পরাজিত ইংল্যান্ড৷ এ কারণেই তো তাঁরা ফাইনালের দল; চ্যাম্পিয়ন দল নয়৷
শুরুর পাঁচের মধ্যে ১৯৭৫ ও ১৯৮৩ সালের অন্য দুই বিশ্বকাপেও সেমিফাইনাল পর্যন্ত ওঠে ইংল্যান্ড৷ অথচ কী আশ্চর্য ? প্রথম পাঁচ বিশ্বকাপে তিনবার ফাইনাল ও দুবার সেমি খেলা দলটি পরের ছয় আসরে কোনোবার শেষ চারে নাম লেখাতে পারেনি পর্যন্ত!
এদিকে সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে ইংলিশ অধিনায়ক মরগান জানিয়ে দিলেন কিউই অধিনায়ক উইলিয়ামসনকে খালি হাতেই ঘরের পথ দেখাতে চান তিনি। এই বিশ্বকাপের জন্য কতটা মুখিয়ে আছেন তিনি তা তার প্রথম কথাতেই বুঝিয়ে দিলেন।
তিনি বলেন, ফাইনালে ওঠার অর্থটা আমার ও আমার দলের কাছে অনেক বড়। এটা চার বছরের কঠোর পরিশ্রম, প্রত্যয় এবং দীর্ঘ সব পরিকল্পনার ফসল। এখন আমাদের সামনে অনেক বড় সুযোগ বিশ্বকাপ জিতে নেয়ার।
এতটা মরিয়া হবেনা কেন! সেই ১৯৭৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপের আয়োজন এই ইংল্যান্ডেই। এরপর টানা তিনবারের আয়োজক। তাতে কি মিলেছে তাদের? শুধু মাত্র বিশ্বকাপে তিনবার রানার্স আপ হওয়া ছাড়া! তাও দুই বার টানা ফাইনালে হেরেছে। ৪৪ বছরে বিশ্বকাপে ক্রিকেটের জন্মস্থানে আসেনি রাজার মুকুট। মিলেছে শুধু আক্ষেপই। তাই এবার লডর্সে সেই আক্ষেপ ভোলানোর মিশন মরগানের দলের সামনে।
সংবাদ সম্মেলনে উৎফুল্ল কেন উইলিয়ামসনও। রাউন্ড রবিন লিগের শেষ তিন ম্যাচ হারলেও বিশ্বকাপের প্রথম ৬ ম্যাচ অজেয় থাকায় সেরা চারের শেষ দল হয়ে সেমিফাইনালে উঠেছিল নিউজিল্যান্ড। টুর্নামেন্টের শুরু থেকে ‘আন্ডারডগ’ হিসেবে খেলে প্রথম পর্ব উতরে যাওয়া দলটিই সেমিফাইনালে হারিয়ে দেয় ‘ফেভারিট’ ভারতকে। ফাইনালেও তাদের সামনে ফেভারিট ইংল্যান্ড। শিরোপার দৌঁড়ে মনস্তাত্ত্বিকভাবে স্বাগতিকদের চেয়ে পিছিয়ে থাকবে কিউইরা, কিন্তু ‘আন্ডারডগ’ হিসেবে মাঠে নামায় উৎফুল্ল অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন।
লর্ডসে ফাইনালের আগে সবশেষ সংবাদ সম্মেলনে বোঝা গেলো কতটা নির্ভার কিউই অধিনায়ক। সাংবাদিকরা তার চোখেমুখে চাপের কোনও ছিটেফোটা খুঁজে পাননি। আন্ডারডগ বলেই কি ফাইনালে দেখিয়ে দেওয়ার তাড়না বেশি পাচ্ছেন? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই হাসির রোল উঠলো পুরো সংবাদ সম্মেলন কক্ষে, হাসলেন উইলিয়ামসনও।
হাসি থামিয়ে তিনি বলেন, টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই আন্ডারডগ হিসেবে অনেকেই নিউজিল্যান্ডকে দেখছে। আসলে এটা আমাদের জন্যই ভালো। ইংল্যান্ড ফেভারিট মর্যাদা পাওয়ার দাবি রাখে। টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই তারা ফেভারিট ছিল। পুরো টুর্নামেন্টে খেলেছেও ভালো।
এরপরই গম্ভীর কণ্ঠে ব্ল্যাক ক্যাপ অধিনায়ক বললেন, কিন্তু আমরা যেমন ডগই হই না কেন, গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজেদের খেলার দিকে ফোকাস করা। কিন্তু আমরা জানি কোনও দলকে হারাতে হলে ভালো ক্রিকেট খেলতে হবে। আমরা অনেকদিন ধরেই দেখছি, যে কেউ যে কাউকে হারাতে পারে তা ডগের ধরন যেমনই হোক (হাসি)।
ঘুরেফিরে আসছে গত বিশ্বকাপের কথা, যেখানে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে টুর্নামেন্টের আয়োজক ছিল তারা। দক্ষিণ আফ্রিকাকে সেমিফাইনালে হারিয়ে প্রথমবার ফাইনালে উঠেছিল। কিন্তু মেলবোর্নে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয় তাদের। ৪ বছর পর আবারও ফাইনালে নিউজিল্যান্ড, উইলিয়ামসনের নেতৃত্বে এবারও তারা মুখোমুখি স্বাগতিকদের। ওই হতাশার পুনরাবৃত্তি হবে নাকি আরেকটি সুযোগ কাজে লাগিয়ে উৎসবে মাতবে কিউইরা, কে জানে?
কিন্তু উইলিয়ামসন কী মনে করছেন? অধিনায়কের সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘আপনি কি আবারও ডগ নিয়ে কথা বলছেন? আন্ডারডগ (হাসি)? দেখুন, আমরা উপলক্ষটা মাতানোর জন্য সত্যিই মুখিয়ে আছি। এখনকার শুরু আর শেষটার মধ্যে অনেক তফাৎ আছে। কাজেই এটা (আন্ডারডগ) নিয়ে বেশি মাতামাতি কোনও কাজে দেবে না। মাঠে খেলতে নামলে অনেক চাপ ও অনেক ভিন্নধর্মী বিষয় সামলাতে হয়। আমরা এটুকু বলতে পারি, এই মুহূর্তে পুরো দল ফাইনাল খেলতে প্রস্তুত।