সারাদেশে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে প্রতিবন্ধীসহ ১৭ জনকে গণপিটুনি

  • ২২-Jul-২০১৯ ০৬:০২ পূর্বাহ্ণ
Ads

:: ভোরের পাতা ডেস্ক ::

ছেলেধরা সন্দেহে দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনিতে কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দফতর থেকে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার জন্য সবার প্রতি আহবান জানানোর পরও রোববার (২১ জুলাই) রাজশাহী,বগুড়া, দিনাজপুর ও টাঙ্গাইলসহ বেশ কয়েকটি জেলায় ১৭জন গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজন মানসিক ভারসাম্যহীন।

প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবাদে বিস্তারিত:

বগুড়া: বগুড়া শহরের শাখারিয়ার তিলেরপাড়ায় রোববার বিকালে এবং সান্তাহারে সকালে ছেলেধরা সন্দেহে দুই ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়েছে এলাকাবাসী। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাদের উদ্ধার করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন। তাদের একজন বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার সাজাপুর গ্রামের আবদুল খালেকের ছেলে আফজাল হোলেন (৪২)। অপরজনের পরিচয় জানা যায়নি। সদর থানার এসআই নুরে আলম জানান, বিকালে অজ্ঞাত এক যুবক (২৭) শাখারিয়া ইউনিয়নের তিলেরপাড়ায় এক শিশুর সঙ্গে কথা বলে। এ সময় শিশুটি ভয়ে বাড়িতে গিয়ে জানায়, তাকে ছেলেধরা নিয়ে যেতে এসেছে। এ খবর প্রচার হলে গ্রামবাসীরা তাকে মারপিট করে।

এ সময় ওই ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবদুল জলিল তাকে উদ্ধার করে ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে যান। চেয়ারম্যানের ধারণা- ওই ব্যক্তি মানসিকভাবে অসুস্থ। পুলিশ জানায়, তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

এদিকে, সান্তাহার পুলিশ ফাঁড়ির ইন্সপেক্টর আনিসুর রহমান ও ইউপি সদস্য শফিক উদ্দিন জানান, সকাল ১০টার দিকে আফজাল হোসেন সান্তাহারের লোকো কলোনী এলাকায় ঘোরাফেরা করছিল। ছেলেধরা সন্দেহ হলে স্থানীয়রা তাকে মারধর করে। খবর পেয়ে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। ইউপি সদস্য জানান, আফজাল হোসেন মানসিকভাবে অসুস্থ। তিনি গত ১০ দিন আগে বাড়ি থেকে বের হয়েছেন।

রাজশাহী: রাজশাহী নগরীর বিনোদপুর মিজানের মোড় এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে তিনজনকে গণপিটুনি দিয়েছে এলাকাবাসী। এসময় তাদের প্রাইভেট কার ভাঙচুর করা হয়। রোববার দুপুরে এ ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে তাদের উদ্ধার করে থানা হেফাজতে নেয় বলে জানান মতিহার থানার ওসি হাফিজুল রহামন।

এরা হলেন, দেওয়ান বাছার (৪৫), ইউসুফ আলী (৩৮) ও প্রাইভেট কারের ড্রাইভার শামীম রেজা (১৯)। তারা তিনজন রাজশাহী এগ্রো ফুডস এন্ড বেভারেজ কোম্পানির কর্মকর্তা কর্মচারি।

তিনি জানান, এই তিন ব্যক্তি একটি কোম্পানির প্রচারের জন্য শিশুদের চিপস খাওয়াচ্ছিল। এ সময় স্থানীয় লোকজনের মধ্যে সন্দেহ জাগে। এলাকাবাসী জিজ্ঞেস করেন, তারা কোন কোম্পানি থেকে এসেছেন এবং তাদের তিনজনের পরিচয়পত্র দেখতে চান। তারা পরিচয়পত্র দেখাতে ব্যর্থ হলে ছেলেধরা সন্দেহে তদের ধরে গণপিটুনি দেয় এলাকাবাসী। এ সময় তাদের প্রাইভেট কার ভাংচুর করে তারা।

ওসি বলেন, খবর পেয়ে দ্রুত পুলিশ গিয়ে তাদের উদ্ধার করে থানা হেফাজতে নেয়। পরে থানায় ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে তাদের ৫০ হাজার টাকা জমিমানা করা হয়েছে। ভোক্তা অধিকার আইন অনুযায়ি বিএসটিআই এর অনুমোদন ছাড়া চিপস তৈরী এবং রাস্তার পাশে শিশুদের খাওয়ানোর অপরাধে তাদের জরিমানা করা হয়েছে। রাজশাহী সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে তারা চিপস তৈরী করে বাজার জাত করছিল বলে জানান ওসি।

দিনাজপুর: চিরিবন্দর উপজেলার ভিয়াইল ইউনিয়নের নানিয়াটিকর গ্রামে রোববার দুপুরে ছেলেধরা সন্দেহে মিরু মিয়া (৫০) নামে এক ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে এলাকাবাসী। আটক মিরু মিয়া কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার আব্দুল হাইয়ের ছেলে। এলাকাবাসী জানায়, মিরু মিয়া একটি পুরাতন চটের বস্তা নিয়ে নানিয়াটিকর গ্রামে ঘোরাঘুরি করে।

এ সময় এলাকার লোকজন তাকে ছেলেধরা মনে করে গণপিটুনি দেয়। খবর পেয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য মাবিয়া বেগম পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে যায়। চিরিরবন্দর থানার পরিদর্শক (ওসি) হারেসুল ইসলাম বলেন, আটক মিরু মিয়া একজন আধাপাগল ব্যক্তি। ছেলেধরা সন্দেহে পাগলদের মারধর না করতে সকলের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

টাঙ্গাইল: কালিহাতী উপজেলার সয়া বাজারে ছেলেধরা সন্দেহে মিনু (৩২) নামে এক ভ্যানচালককে গণপিটুনি দিয়েছে স্থানীয়রা। মিনু ভূঞাপুর উপজেলার টেপিবাড়ি গ্রামের কুরবান আলীর ছেলে। কালিহাতী থানার এসআই এসএম ফারুকুল ইসলাম জানান, দুপুরে ছেলেধরা সন্দেহে স্থানীয়রা তাকে গণপিটুনি দেয়। খবর পেয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় ওই ব্যক্তিকে উদ্ধার করে পুলিশ।

পরে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে পাঠায়। খবর পেয়ে স্বজনরা হাসপাতালে গিয়ে তার পরিচয় নিশ্চিত করেন। তারা জানান, বন্যার পানিতে মাছ ধরার জন্য জাল কিনতে তিনি সয়া বাজারে এসেছিলেন। কাউকে সন্দেহজনক মনে হলে আইন হাতে না নিয়ে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার আহ্বান জানান টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সঞ্জিত কুমার রায়। এদিকে একই দিন সকালে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার গালা ইউনিয়নের কান্দিলা বাজারে ছেলেধরা সন্দেহে এক যুবককে মারধর করে গুরুত্ব আহত করেছে এলাকাবাসী। খবর পেয়ে পুলিশ ওই যুবককে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে।

নওগাঁ: জেলার মান্দা উপজেলার বুড়িদহ গ্রামে রোববার ছেলেধরা সন্দেহে ছয় ব্যক্তিকে গণপিটুনি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গণপিটুনির শিকার ছয় ব্যক্তি হলেন নওগাঁ সদর উপজেলার খাগড়া গ্রামের সাদ্দাম হোসেন, তসলিম হোসেন, সাইফুল ইসলাম, আবদুল মজিদ আকন্দ ও আনিছুর রহমান এবং সদর উপজেলার ফারতপুর গ্রামের রেজাউল করিম।

স্থানীয় বাসিন্দা ও থানা-পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আজ সকাল ৮টার দিকে এই ছয়জন উপজেলার বুড়িদহ গ্রামের রণজিৎ কুমার চৌধুরীর পুকুরে চুক্তিভিত্তিক মাছ ধরতে যান। পুকুরের মালিকের সঙ্গে তাঁদের চুক্তি ছিল যে তাঁরা শুধু ছোট মাছ ধরবেন। কিন্তু তাঁরা কয়েকটি বড় মাছও ধরে ফেলেন। এ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে পুকুরমালিকের কথা-কাটাকাটি শুরু হয়। কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে পুকুরের মালিক ও গ্রামের লোকজন ছয় জেলেকে মারধর করতে শুরু করেন। তাঁরা নিজেদের বাঁচাতে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। এ সময় গ্রামের লোকজন ‘ছেলেধরা’ বলে চিৎকার করতে শুরু করলে আরও লোকজন ছুটে গিয়ে প্রথমে সাদ্দাম হোসেন নামের এক জেলেকে আটক করেন। ‘ছেলেধরা’ পালিয়ে গেছে খবর রটে গেলে পাশের খুদিয়াডাঙ্গা গ্রামের লোকজন অন্য পাঁচজন জেলেকে আটক করে পিটুনি দেয়।

মান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোজাফফর হোসেন বলেন, পুকুরে মাছ ধরা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে গ্রামবাসী ‘ছেলেধরা’ গুজব রটিয়ে ছয় ব্যক্তিকে মারধর করেছেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাঁদের উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। তাঁরা এখন থানা হেফাজতে আছেন। ঘটনা তদন্তে তাঁদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ইকবাল হোসেন বলেন, ‘এটা পুরোপুরি গুজব। এ ধরনের গুজবে কাউকে কান না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।

লালমনিরহাট: ছেলেধরা সন্দেহে শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে লালমনিরহাট শহরের খোঁচাবাড়ি মৌজার ডাইলপট্টি এলাকায় মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারীকে (৪৫) আটক করে এলাকাবাসী পিটুনি দেয়। সংবাদ পেয়ে ওই নারীকে রক্ষা করতে গিয়ে লালমনিরহাট সদর থানার এসআই জিল্লুর রহমান আহত হন। বর্তমানে তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। লালমনিরহাট সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এরশাদুল আলম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

লালমনিরহাটের এসপি এস এম রশিদুল হক বলেন, আইন নিজের হাতে তুলে নিলে বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটালে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কুমিল্লা: ছেলেধরা সন্দেহে কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার দুতিয়ার দিঘির পাড় এলাকায় এক নারীসহ তিনজনকে পিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে জনতা। তাঁরা হলেন জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বেজোড়া গ্রামের আবদুস সালাম (৭০), তাঁর স্ত্রী রত্না বেগম (৪০) ও একই গ্রামের রিকশাচালক আনোয়ার হোসেন (৩০)। তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানায় নেওয়া হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী অন্তত তিনজন ব্যক্তি বলেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সালাম ও রত্না দম্পতি রিকশা নিয়ে আদর্শ সদর উপজেলার আমড়াতলি ইউনিয়নের দুতিয়ার দিঘি এলাকায় যান। একটি বাড়ির সামনে গিয়ে স্কুলগামী এক শিশুকে কথা আছে বলে ডাক দেন। তখন আশপাশের বাসিন্দারা বিষয়টি টের পেয়ে চিত্কার করেন। এই সময়ে তাঁরা রিকশা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরে জনতা তাঁদের ধরে পিটুনি দেন। পরে পুলিশে খবর দিয়ে তাদের সোপর্দ করা হয়। কোতোয়ালি মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে গতকাল কুমিল্লার লাকসাম পৌরসভার পেয়ারাপুর এলাকায় রফিকুল ইসলাম (৪৩) নামের এক ভিক্ষুককে ছেলেধরা সন্দেহে পিটুনি দিয়ে তাঁর পা ভেঙে দেন এলাকাবাসী। তিনি বর্তমানে লাকসাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন।

Ads
Ads