জবি ও ইডেন ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে সেসব বিতর্কিতদের বসাতে মরিয়া সিন্ডিকেট!

  • ৫-Sep-২০১৯ ০১:২১ অপরাহ্ন
Ads

::উৎপল দাস::
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ হাতে গড়া ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের একমাত্র ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাঙালি, বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের গৌরবের অংশীদার এই ছাত্রলীগ। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠা একটি অশুভ সিন্ডিকেটের কবল থেকে রক্ষা করতেই ছাত্রলীগকে ঢেলে সাজাতে চেয়েছেন ছাত্রলীগের সর্বোচ্চ অভিভাবক, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে যাচাই বাছাই করে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে সভাপতি ও গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি করেছেন। এ কমিটি যথেষ্ট নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের সেই কালো থাবা থেকে ছাত্রলীগকে মুক্ত করতে। কিন্তু পুরোনো সিন্ডিকেটের বলয় থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি, এরই মাঝে নতুন সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। যে সিন্ডিকেটের প্রভাবশালী সদস্যদের মধ্যে দুইজন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা রয়েছেন। যাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ছাত্রলীগকে বিতর্কমুক্ত করা। মন্ত্রীত্ব, এমপি পদ হারানো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দুই নেতার ইশারাতেই চলছে ছাত্রলীগ। এমন কথা ছাত্রলীগের ভেতরের নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে। 

এদিকে, ঢাকার দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট হিসাবে খ্যাত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে ভাগিয়ে নিয়ে দুই ধরণের সিন্ডিকেটই সক্রিয় রয়েছে। বিশেষ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ও পুরোনো দুই সিন্ডিকেটের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে শীর্ষ পদে বিতর্কিতরাই আসতে পারে বলে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছেন। পুরোনো সিন্ডিকেটের অন্যতম একজন হোতা হিসাবে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সংসদ সদস্য রয়েছেন। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) থেকে ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে এসেছিলেন, তার ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটতে পারে এবারের কমিটিতে। এছাড়া নতুন সিন্ডিকেটের একজন রয়েছেন যিনি আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা। তিনি এমপি ও মন্ত্রিত্ব হারানোর বেদনায় এখন ছাত্রলীগে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পছন্দের লোক বসাতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এই দুই নেতার রেষারেষির কারণে সম্মেলনের পরও এখনো ছাত্রলীগের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি ঘোষণা করা হচ্ছে না। 

এমনকি ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সব ধরণের সিন্ডিকেটকে পিছনে পেলে ছাত্রলীগের সোনালী দুঃসময়ের অহংকার, যিনি ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতা থেকে আওয়ামী লীগেরও শীর্ষ পদে আছেন তিনিই নিয়ন্ত্রক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের আগামী সম্মেলনে ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন নেতা যিনি সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য লড়াই করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, তার সঙ্গেও ইডেন ছাত্রলীগের সেই নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এই প্রতিযোগিতার কারণেই বিতর্কিতরাই ইডেনের কমিটিতে ঠাঁই পেতে পারেন না ধারণা করা হচ্ছে। 
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটিতে শীর্ষ পদ বাগিয়ে নিতে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে কয়েকজন বিতর্কিত। তাদের মধ্যে রয়েছেন, জবি ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি আশরাফুল ইসলাম টিটন। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও ভর্তি বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া কোতোয়ালি থানায় মামলা আছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া শিবির সম্পৃক্ততার সুনিদির্ষ্ট অভিযোগ রয়েছে। জবি ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, জবি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এফ এম শরিফুল ইসলামের সব অপকর্মের অন্যতম সহযোগী ছিলেন আশরাফুল। সারা দেশে আলোচিত পত্রিকার  শিরোনাম ‘জবি ছাত্রলীগের সভাপতির টয়লেট দখল’-এর মূল কারিগরও আশরাফুল টিটন।

এ বিষয়ে আশরাফুল ইসলাম টিটন গণমাধ্যমকে বিভিন্ন সময় বলেছেন, ‘মামলা আমার বিরুদ্ধে হয়েছে সেটা ঠিক আছে। তবে যতক্ষণ না পর্যন্ত মামলার চার্জশিট হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাকে কেউ দোষী বলতে পারবে না। আর টয়লেট দখলের বিষয়টা আমি তখন শরিফ ভাইয়ের সঙ্গে রাজনীতি করতাম ঠিকই। তবে আমি এসবের মধ্যে ছিলাম না।’

পদপ্রত্যাশীদের অন্যতম জবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হোসনে মোবারক রিসাদ। তাঁর বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসের সামনে টিএসসিতে দোকান বসিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে মারামারি, নিজ বিভাগে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাসহ নানা অভিযোগ আছে। সর্বশেষ চাঁদা নিয়ে মারামারি অভিযোগে ছাত্রলীগ থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়।

অভিযোগের ব্যাপারে হোসনে মোবারক রিসাদ বলেন, ‘আমি তরিকুল-রাসেলের কমিটি ক্যাম্পাস থেকে বিতারিত করায় আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করা হয়েছে। আর আমাকে বহিষ্কার করাটাও ছিল ষড়যন্ত্রমূলক।’

পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে আরেকজন হলেন আল আমিন শেখ। তাঁর বিরুদ্ধে পুরান ঢাকার বিভিন্ন হোটেলে ফ্রি খাওয়াসহ মাসিক হারে বাস স্টেশন থেকে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

আল আমিন শেখ অভিযোগের বিষয়ে বলেন, ‘আমি সভাপতি প্রার্থী হওয়ার পর থেকে এসব গুজব ছড়াচ্ছে। আমি এসবের আশপাশে নেই।’

পদপদপ্রত্যাশীদের আরেকজন আসাদুজ্জামান আসাদ। রাজনীতিতে কখনো সক্রিয় না থাকলেও বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর এলাকার হওয়ায় জবির শীর্ষ পদ পেতে মরিয়া তিনি। আসাদুজ্জামান আসাদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। প্রতিদিনই রাজনীতি করেছি। আপনি খবর নিয়া দেখেন।’

এদিকে, ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়েছে ২০ জুলাই। ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি সেপ্টম্বর মাসেই চূড়ান্ত হয়ে যাবে ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ এই দুই কমিটির নেতৃত্ব নির্ধারণ। 

২০১৬ সালের ১ নভেম্বর তাছলিমা আক্তারকে আহ্বায়ক, ১৫ জন যুগ্ম আহ্বায়ক ও ৪৩ জন সদস্য নিয়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন। প্রায় তিন বছর ধরে এই আহবায়ক কমিটি দিয়েই চলেছে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম।

এদিকে,  ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের এই সম্মেলনের পর থেকেই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পদ পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন পদ-প্রত্যাশী নেত্রীরা। দুই শীর্ষ পদে এগিয়ে রয়েছেন নানাভাবে সমালোচিত ও বির্তকিত নেত্রীও। শুধু বিতর্কিত তাই নয়, বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত সন্তানরাও আলোচনায় রয়েছেন বলে জানা গেছে। 

ছাত্রলীগ সূত্র জানায়, ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ প্রত্যাশীর সংখ্যা কমপক্ষে ২০ জন। এরমধ্যে  শীর্ষ পদে জন্য যারা আলোচনায় আছেন পাপিয়া রায়, তামান্না জেসমিন রিভা, জান্নাত আরা জান্নাত, পাপিয়া প্রিয়া, বিপাশা রনি ও ইসরাত জাহান ইতি। জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে রোকসানা আকতার, বিথী আকতার,  নাজমা আকতার, সুমনা মল্লিক পপি, সানজিদা জাহান, কামরুন্নাহার, বিপাশা রনি, সুখী, সোনালী, সাবিকুন্নাহার তামান্না, জেবুন্নাহার শিলা, মাহমুদা সুমি, বেনজির সেবার নাম। 

জানা গেছে, ইডেন ছাত্রলীগের দায়িত্ব পেলেই ‘হল বাণিজ্য’সহ শূন্য থেকে কোটিপতি হয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেক নেত্রী। তারা ঢাকায় বিলাসী জীবন যাপনের পাশাপাশি গ্রামের বাড়িতেও করেছেন বহুতল ভবন। রয়েছে ব্যক্তিগত গাড়িও। লোভনীয় এই পদে আসতে জোর লবিং শুরু করেছেন বির্তকিত এসব নেত্রীরা। তারা ‘যে কোন মূল্যে’ পদ চান। বির্তকিত ও অনুপ্রবেশকারী এসব নেত্রীদের কারণে ‘অনেক’ কোণঠাসা পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগ রাজনীতির সাথে জড়িত ও ছাত্রলীগের ত্যাগী নেত্রীরা। 

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতির অনুসারী সিরাজগঞ্জের মেয়ে জান্নাত আরা জান্নাতের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ইডেন ছাত্রলীগ নেত্রীদের। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ,  ২০১৬ সালের মার্চের পর প্রয়োজনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হওয়া জান্নাত এখন কোটি টাকার মালিক। বাবা তাড়াশ সদর ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি। এক চাচা বাবলু তাড়াশ কলেজ ছাত্রদলের নির্বাচিত নেতা ছিলেন। এখন যুবদলের রাজনীতির সাথে জড়িত। আপন ছোটভাই সাফী ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে জড়িত। এখন ছাত্রলীগের সাথে ওঠাবসা করে। ভগ্নিপতি ফরহাদ স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক। এছাড়া জান্নাত আরা জান্নাতের বিরুদ্ধে হলে নিজ কর্মীদের মারধর করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।  

এছাড়া পাপিয়া রায়ের বিরুদ্ধেও একজন সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রীর স্বামীকে নিয়ে পুরোনো কেলেংকারি রয়েছে। যদিও তিনি বারবার এটিকে ষড়যন্ত্র হিসাবে দাবি করেছেন। তামান্না জেসমিন রিভার বিরুদ্ধে হলে সিট বাণিজ্য থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার সঙ্গে বিশেষ সুসম্পর্কের গুঞ্জনও শোনা যায়। পাপিয়া প্রিয়া ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের এক সাবেক নেতাকে গোপনে বিয়ে করেছেন বলেও দাবি করেছেন তারই ঘনিষ্ঠজনরা। এছাড়া রোকসানা আকতারের বিরুদ্ধেও যৌন কেলেংকারি ফাঁসের অভিযোগ রয়েছে। 

এদিকে, ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী গুরুত্বপূর্ণ দুটি ইউনিটের শীর্ষ নেতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোনো ধরণের সিন্ডিকেটের প্রভাব কাজে আসবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। অধিকতর পরিচ্ছন্ন, মেধাবীদের কমিটিতে আনা হবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের শীর্ষ কমিটিতে। 

Ads
Ads