শোভন-রাব্বানীকে চাপে ফেলতে নেপথ্যে আ. লীগের প্রভাবশালী তিন নেতার ভিন্নরকম স্বার্থ!

- ৯-Sep-২০১৯ ১০:০৬ পূর্বাহ্ণ
::উৎপল দাস::
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ হাতে গড়া ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের একমাত্র ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। সংগঠনটির সর্বোচ্চ অভিভাবক হিসাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের অন্যান্য সহযোগী সংগঠনকে নিয়ে যতটা ভাবেন না, তার চেয়ে অনেক বেশি ভাবনার বিষয় ছাত্রলীগকে নিয়ে। আওয়ামী লীগ রাজনীতির আঁতুরঘর হিসাবে বিবেচিত ছাত্রলীগ নিয়ে এতটাই সচেতন প্রধানমন্ত্রী যে, অদৃশ্য সেই সিন্ডিকেটের রাহুমুক্ত করতে তিনি নিজে উদ্যোগী হয়েই ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে সভাপতি ও গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক করে দুই বছর মেয়াদী আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়।
এরপর শোভন রাব্বানীর নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগ সাংগঠনিকভাবে তেমন সফলতা দেখাতে না পারলেও দীর্ঘদিনের ইমেজ সংকটকে ফিরিয়ে আনার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এরিমধ্যে গত শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) গণভবনে আয়োজিত আওয়ামী লীগের নির্বাচন ও মনোনয়ন বোর্ডের সভায় অনির্ধারিত আলোচনায় দলের তিন জন প্রভাবশালী নেতা প্রধানমন্ত্রীর কাছে ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি নিয়ে কথা বলেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তিন নেতার কথা শুনে শোভন রাব্বানীর কিছু বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও তারই মনোনীত কমিটি ভেঙে দেয়ার মতো কেনো নির্দেশনা দেননি। পরের দিনই সচিবালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগের সোনালী দুঃসময়ের অহংকার ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, কমিটি ভেঙে দেয়ার মতো কোনো নির্দেশনা দেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে, ভোরের পাতার পক্ষ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সভাপতি শোভন ও সাধারণ সম্পাদক রাব্বানীর কাছে নিজেদের ভিন্নরকম স্বার্থে আঘাত লাগাতেই তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে যৌক্তিকভাবে নালিশ দিয়েছেন। প্রথমেই তিনজনের মধ্যে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ ফোরামের নেতা প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ শেখ হাসিনার কাছে বলেন, ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন কিভাবে নেতাকর্মীদের নিয়ে সিলেট বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বলয় ভেঙে ছিল? নিজের কর্মীদের ওপর কি তাহলে শোভনের নিয়ন্ত্রণ নেই?
এরপরই সেই আলোচনায় প্রবেশ করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। তিনি বলেন, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন যে কমিটি দেয়া হয়েছে সেখানে আর্থিক লেনদেনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। ইবি ছাত্রলীগের সভাপতি এসএম রবিউল ইসলাম পলাশকে কেন্দ্রীয় সভাপতি শোভনের নিজ এলাকা কুড়িগ্রামের। এমনকি শোভনের ঘনিষ্ঠ বড় ভাই যিনি নিজেকে বর্তমান ছাত্রলীগের লিয়াকত শিকদার হিসাবে দাবি করেন সেই বিপ্লব হাসান পলাশকে টাকা ও অনৈতিক কিছু সুবিধা দিয়েছেন এবং ইবি ছাত্রলীগের নব নিযুক্ত সাধারণ সম্পাদক ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র মো. রাকিবুল ইসলাম রাকিব কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে টাকা দিয়ে নেতা হয়েছেন।
আর্থিক লেদদেনের মাধ্যমে কমিটি দেয়ার পাশাপাশি ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার আচরণগত কিছু সমস্যা নিয়েও কথা বলেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পছন্দের বিতর্কিতদের দুইজনকে নেতা বানাতে ব্যর্থ হওয়া মাহবুব উল আলম হানিফ।
এরপর ছাত্রলীগের সোনালী দুঃসময়ের অহংকার ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কথা বলেন। তিনি শোভন রাব্বানী দুপুরের পর ঘুম থেকে উঠেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ডেকে নিয়ে অসম্মান করার যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে তা নিয়ে কথা বলেন।
উল্লেখ্য, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কমিটিতে নিজের পছন্দের কাউকে নেতা বানাতে না পেরে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করতে না পারায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দলের মনোনয়ন বোর্ডের সভার অনির্ধারিত আলোচনায় শোভন-রাব্বানীর ভুলগুলো তুলে ধরেছেন। এছাড়া কাজী জাফর উল্লাহ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই নেতার মধ্যে গোলাম রাব্বানীর ওপর কিছু ক্ষিপ্ত। কারণ কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার আগে কাজী জাফর উল্লাহ কয়েকটি পদ চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই পদগুলো দেয়া হয়নি। এমনকি বৃহত্তর ফরিদপুরের তৃণমূল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পিছিয়ে পরা কাজী জাফর উল্লার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্ধী নিক্সন চৌধুরী এমপির বড় ভাই জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী এমপির সাথে রাব্বানীর ঘনিষ্ঠতাকে মেনে নিতে পারছেন না সহজভাবে। তিনি চেয়েছিলেন রাব্বানী তার কথায় চলুক এবং রাজনীতি করুক।
এরপর রাজধানী ঢাকায় ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট হচ্ছে ইডেন কলেজ। এই কলেজের ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্ধারণে অদৃশ্যভাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের একটি হস্তক্ষেপ সব সময়ই থাকে। তাসলিমা আক্তারকে আহ্বায়ক করে সাইফুর রহমান সোহাগ এবং এস এম জাকির হোসেনের আমলে যে ৫১ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছিল, সেখানে পুরো কমিটির সবাইকে ব্যাক্তিগতভাবেই চিনতেন ওবায়দুল কাদের। এমনকি আহ্বায়ক কমিটি হওয়ার আগে বক্তৃতার সময় ওবায়দুল কাদের নিজের মুখেই বলেছিলেন, ইডেন কলেজের কমিটিতে কে আসবেন, কে আসবেন না তা নির্ধারণ করবেন সোহাগ-জাকির। কিন্তু ৫১ জনের নামের তালিকায়ই এসেছিল ওবায়দুল কাদেরের হাত ঘুরে। এ অবস্থায় গত ২৪ জুলাই ইডেন কলেজের সম্মেলন হওয়ার পরও নতুন কমিটি গঠন করতে পারছেন না শোভন ও রাব্বানী। কেননা এই কমিটি নিয়ে অদৃৃশ্যভাবে ওবায়দুল কাদের তার নিজস্ব লোকজন দিয়ে প্রভাব বিস্তার করে খুব পছন্দের নেত্রীদের নেতৃত্বে আনতে চান। এমনকি ওবায়দুল কাদেরকে ৩১ আগস্টে গণভবনে আয়োজিত ছাত্রলীগের শোক দিবসের আলোচনায় মঞ্চে চেয়ার না দেয়ার অভিমানে তিনি সেই অনুষ্ঠানেই আসেননি। এতেও তিনি বেশ ক্ষেপেছেন ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির ওপর।
উল্লেখ্য, বর্তমান ছাত্রলীগের দেখবাল করার জন্য আওয়ামী লীগের চার জন কেন্দ্রীয় নেতাকে দায়িত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারা হলেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নাকক ও আব্দুর রহমান এবং সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক ও বাহাউদ্দিন নাসিম। বর্তমান ছাত্রলীগ নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে তারাই অফিসিয়ালি দায়িত্বপ্রাপ্ত। তবে চার নেতার বিরুদ্ধেও ছাত্রলীগ নিয়ে কারসাজির অভিযোগ রয়েছে। এমনকি বিতর্কিতদের বাদ দিতে না পারা ব্যর্থতা শেখ হাসিনার কাছে এই দায়িত্বপ্রাপ্তদেরও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।