জিকে শামীমের কাছ থেকে গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী রফিক-সাহাদাতের ‘সাতশ’ কোটি টাকা কমিশন বাণিজ্য! (পর্ব ০১)

- ২০-Sep-২০১৯ ০২:১৯ অপরাহ্ন
:: উৎপল দাস ::
টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের মধ্যে অনুপ্রবেশকারীরা দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করেই চলেছে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে এ্যাকশনে গিয়েছেন। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইতিমধ্যে যুবলীগে অনুপ্রবেশকারী দুই নেতাকে আটক করেছে। তাদের মধ্যে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ ভূইয়াকে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এছাড়া শুক্রবার যুবদলের নেতা থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা খরচ করে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতার আর্শিবাদে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায় সম্পাদক ও নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বনে যান। ভোরের পাতার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য। সরকারের উন্নয়ন ধারা অব্যাহত রাখতে গণপূর্ত অধিদপ্তরের মতো গুরুত্বপূর্ণ অধিদপ্তরটিকে গিলে ফেলেছিলেন। তার মাধ্যমেই সব ধরণের বড় অংকের দরপত্র/ টেন্ডার বাণিজ্য চলতো। বিএনপি জামায়াতের অনুসারী হিসাবে জিকে শামীমের সঙ্গে মিলেমিশে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম এবং বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী সাহাদাত হোসেন কমপক্ষে সাতশ কোটি টাকার কমিশন বাণিজ্য করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনগুলোতে অনুপ্রবেশকারীদের দুর্নীতি নিয়ে ভোরের পাতার অনুসন্ধানী ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার সন্মানদী ইউনিয়নের দক্ষিণপাড়া গ্রামের মৃত মো. আফসার উদ্দিন মাস্টারের ছেলে এই জিকে শামীম। আফসার উদ্দিন মাস্টার ছিলেন হরিহরদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিন ছেলের মধ্যে জি কে শামীম মেজো। যুবলীগের কেন্দ্রীয় সমবায় সম্পাদক জি কে শামীমের নিকেতনের বাড়ি ঘেরাও করে অভিযান চালায় র্যাব। শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার পর এ অভিযান শুরু হয়।
জি কে শামীম একসময় বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের ক্যাডার ছিলেন। বিএনপির আমলে জি কে শামীমের ভয়ে মতিঝিল, পল্টন, শান্তিনগরের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পালিয়ে বেড়িয়েছেন। সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজি ছিল তার পেশা। ওই সময় মির্জা আব্বাসের ডানহাত হিসাবে গণপূর্ত ভবনের সকল টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আশার পরও তিনি বহাল তবিয়তে ওই ভবন নিয়ন্ত্রণ করে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে। জীবনের ভয়ে অনেক আওয়ামী লীগের ঠিকাদার ওই ভবন ছেড়ে পালান। বাংলাদেশের সকল ঠিকাদারকে গণপূর্তে কাজ করতে হলে তাকে বলে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের প্রথম সারির (১-২০) সকল ঠিকাদার তার বাইরে ভয়ে কথা বলার সাহস পান না। এক অর্থে বলা যায়, গণপূর্ত ভবনের মালিকই তিনি।
এদিকে, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কারাগারে বন্দী বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ টেন্ডার মাফিয়া হিসাবে খ্যাত আব্দুল বাতেন শিকদারের একনিষ্ঠ শিষ্য হিসাবে কাজ করেছেন এই জিকে শামীম। এরপর তারেক রহমানের আর্শিবাদপুষ্ট হয়ে মির্জা আব্বাসের ক্যাডার হিসাবে মতিঝিল, খিলগাঁও, আরামবাদ, পল্টন নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। এরপর গণপূর্ত ভবনে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেন। হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের উদ্দেশ্যেই গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামকে দুই মেয়াদে সেখানকার প্রধান প্রকৌশলী রাখা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার শিরোমনি গোলাম আজমের ভাগিনা হিসাবে এই সরকারের আমলে গণপূর্ত অধিদপ্তরে দুর্নীতি আর লোপাট রাজ্য খুলে বসেছিলেন খোদ রফিকুল ইসলাম এবং জিকে শামীম। শুধু শামীমের কথায় কাজ দিয়ে এই রফিকুল ইসলাম কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকার বেশি কমিশন বাণিজ্য করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পর্যন্ত অনুসন্ধানে নেমেছিল। তবে শুক্রবার সন্ধ্যায় রফিকুল ইসলামকে ভোরের পাতা অফিস থেকে ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
এদিকে, বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী সাহাদাত হোসেনও কুমিল্লায় একসময় শিবিরের রাজনীতির সাথে সক্রিয় ছিলেন। রাজাকার গোলাম আজমের ভাগিনা রফিকুল ইসলামের যোগ্য উত্তরসূরী হিসাবেই জিকে শামীমের সাথে সখ্যতা বজায় রেখে এখনো পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছেন। জিকে শামীমের কাছ থেকে কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকার কমিশন বাণিজ্য করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে, এক বছরেরও কম সময়ে গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী সাহাদাত হোসেন এত টাকা কমিশন বাণিজ্য কিভাবে করলেন তা খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ঠিকাদাররা। এসব অভিযোগের বিষয়ে ভোরের পাতার পক্ষ থেকে ফোন করা হলে প্রধান প্রকৌশলী কমিশন বাণিজ্যের কথা অস্বীকার করলেও জিকে শামীমের সঙ্গে বিশেষ সখ্যতার বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি।
জিকে শামীমের সঙ্গে গণপূর্ত অধিদপ্তরের আরো দুইজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর বিশেষ যোগসাজশ রয়েছে বলেও জানা গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন মোঃ আশরাফুল আলম অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, রংপুর গণপূর্ত জোন উৎপল কুমার দে, অতরিক্তি প্রধান প্রকৌশলী, ঢাকা গণপূর্ত মেট্রপলিটন জোন। এই দু’জনের সঙ্গেও কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান গণপূর্ত ভবনের অনেকেই।
জিকে শামীমের মতো দুর্নীতিবাজ, অনুপ্রবেশকারী রাজনীতিবিদদের সঙ্গে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী থেকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীদের বিশেষ যোগসাজশের বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। জিরো টলারেন্স নীতিতে তিনি নিজ দলের মধ্যে অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছেন। গণপূর্তে আগেও অনেক অভিযোগ ছিল। বর্তমান যারা দায়িত্বে আছেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অবশ্যই খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে। (চলবে...)