যেভাবে ফুটপাত থেকে শতকোটি টাকার মালিক হলেন শাহাবুদ্দিন

- ২২-Sep-২০১৯ ১০:০১ পূর্বাহ্ণ
:: ভোরের পাতা ডেস্ক ::
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গুলিস্তানের ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করতেন মো. শাহাবুদ্দিন। সে সময় জড়িত ছিলেন ইউনিট যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে। এর পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে হাতে আলাদীনের চেরাগ পেয়ে যান শাহাবুদ্দিন। যুবলীগ নেতা ফরিদউদ্দিন রতনের হাত ধরে যুবলীগের মিছিল-মিটিংয়ে যোগ দিতে শুরু করেন।
গুলিস্তানের ফুটপাতে তার নিজ এলাকা বৃহত্তর নোয়াখালীর বিপুল সংখ্যক ব্যবসায়ী থাকায় শক্তি বাড়তে থাকে শাহাবুদ্দিনের। একপর্যায়ে তিনি ২০ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। এর পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। গুলিস্তান সুন্দরবন স্কোয়ার মার্কেট, আদর্শ মহানগর মার্কেটসহ আশপাশের অধিকাংশ মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ নেন শাহাবুদ্দিন। মার্কেটগুলোয় অবৈধ দোকান স্থাপনসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে থাকেন তিনি। একপর্যায়ে ২০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতির পদ পান; শাহাবুদ্দিন থেকে হয়ে যান হাজী মো. শাহাবুদ্দিন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দাখিল করা অভিযোগে বলা হয়, যুবলীগের প্রভাব খাটিয়ে শাহাবুদ্দিন এখন শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তার নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া ও বঙ্গবাজারের ৫টি মার্কেট। গুলিস্তানের ব্যবসায়ীদের কাছে যুুবলীগ নেতা শাহাবুদ্দিন এখন এক আতঙ্কের নাম। বিভিন্ন মার্কেটের অবৈধ জায়গায় দোকান স্থাপন করে তিন-চারজনের কাছে বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। প্রভাবশালী বিধায় শাহাবুদ্দিনের কাছে কেউ টাকা চাইতে সাহস পান না। শূন্য হাতে গুলিস্তানের ফুটপাতে ব্যবসা করা শাহাবুদ্দিন এখন কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করেন গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া ও বঙ্গবাজার থেকে। মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়াচক্রের আলী আহম্মেদের ডান হাত হওয়ায় ওই ক্লাবের ক্যাসিনো কারবারের টাকার ভাগও যেত তার পকেটে। প্রতিদিন শাহাবুদ্দিন ২০ হাজার টাকা পেতেন মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়াচক্রের ক্যাসিনোর বোর্ড থেকে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, আমি ছোট নেতা। এত বড় কাজ করার ক্ষমতা কি আমার আছে? আমার ওপর মিথ্যা দোষ চাপানো হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সুন্দরবন স্কোয়ার মার্কেটটির একক নিয়ন্ত্রণ যুবলীগ নেতা শাহাবুদ্দিনের হাতে। গুলিস্তানের প্রাণকেন্দ্রে নিয়ম মেনে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা রেখে মার্কেটটি নির্মাণ করা হলেও শাহাবুদ্দিনের দখলদারিত্বের কারণে মার্কেটটির সেই জৌলুস হারিয়ে গেছে। ১২০৮টি বৈধ দোকান থাকলেও শাহাবুদ্দিন সেখানে আরও ৭ শতাধিক অবৈধ দোকান বসিয়ে বিক্রি করেন। বলাবাহুল্য, এ মোটা টাকার কানাকড়িও সিটি করপোরেশনের কোষাগারে জমা হয়নি। দোকানপ্রতি ১০ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ২২ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন তিনি। সিটি করপোরেশনের অনুমোদন ছাড়া এসব দোকান নির্মাণ করে কেবল সুন্দরবন স্কোয়ার মার্কেট থেকেই শাহাবুদ্দিন হাতিয়ে নেন প্রায় ৮০ কোটি টাকা। দোকান বিক্রির এ টাকার ভাগ ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের প্রভাবশালী নেতাসহ সিটি করপোরেশনের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাদের হাতেও গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, সুন্দরবন স্কোয়ার মার্কেটটি চারতলা হলেও সিটি করপোরেশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে আরও একতলা নির্মাণ করেন শাহাবুদ্দিন। এ ছাড়া মার্কেটের প্রতিটি ফ্লোরের বিভিন্ন কমন স্পেস, ফ্লোরপ্রতি দুটি করে টয়লেট, ওজু করার স্থান ছিল। কিন্তু এসব ভেঙে নির্মাণ করা হয় দোকান। ব্যবসার স্বার্থে মার্কেটটির ব্যবসায়ীরা সম্মিলিতভাবে প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করেন ১২টি এস্কেলেটর (চলন্ত সিঁড়ি)। শাহাবুদ্দিন এসব সিঁড়ি ভেঙে ভাঙাড়ির দোকানে বিক্রি করে দেন। বেসমেন্টের জেনারেটর রুমটিও দোকান বানিয়ে বিক্রি করে দেন তিনি।
এখানেই শেষ নয়। তার বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশনের ট্রান্সফরমারও বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। গার্ডরুম, বৈদ্যুতিক সুইচরুম, প্রতি তলায় সিঁড়ির পাশে ও নিচে দোকান তৈরি করেন তিনি। এ ছাড়া লিফটের জায়গা দখল করে নির্মাণ করা হয় বৃহৎ আকারের হোটেল। বেসমেন্টের ওয়াটার রিজার্ভয়েরের স্থানেও দোকান তৈরি করেন তিনি। সব মিলিয়ে অবৈধভাবে সাত শতাধিক দোকান নির্মাণ করেন তিনি।
নতুন করে নির্মিত এসব দোকান সিটি করপোরেশন থেকে স্থায়ী বরাদ্দ দেওয়া হবে বলে গত বছর মেয়রের নামে দোকানপ্রতি ৬ লাখ টাকা নেন শাহাবুদ্দিন। এভাবে তিনি ৩৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা তোলেন। ওই সময় মার্কেটের দোকানের মূল মালিকরা সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সুন্দরবন স্কোয়ার মার্কেটের অন্তত পাঁচজন ব্যবসায়ী আমাদের সময়কে বলেছেন, স্থানীয় ওয়ার্ড যুবলীগের নেতা হওয়ায় শাহাবুদ্দিনের অনাচারের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পেতেন না।
কেবল সুন্দরবন স্কোয়ার মার্কেটই নয়; গুলিস্তানে মহানগর মার্কেট, আদর্শ মার্কেটের অলিখিত নিয়ন্ত্রকও যুবলীগ নেতা শাহাবুদ্দিন। প্রতি মাসে তিনি এসব মার্কেটের দোকান থেকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা উত্তোলন করেন। এ ছাড়া মার্কেটের বিভিন্ন ফাঁকা স্থানেও দোকান বানিয়ে তা বিক্রি করেন শাহাবুদ্দিন। সিটি করপোরেশন এসব দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে।
মহানগর মার্কেটের এক দোকানদার বলেন, শাহাবুদ্দিনের নিয়ন্ত্রণে এ মার্কেট। তিনি যার কাছে ইচ্ছা তার কাছেই দোকান বিক্রি করেন। আবার কেড়ে নিয়ে একই দোকান অন্য কারও কাছে বিক্রি করে দেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অভিনব উপায়ে শাহাবুদ্দিন এসব মার্কেট দখল করেন। প্রথমে তিনি তার অনুগতদের দিয়ে মার্কেটের একটি পাল্টা কমিটি গঠন করেন। যদিও মাকের্টের কমিটির সদস্য হতে হলে প্রত্যেকের নিজস্ব দোকান থাকতে হয়। কিন্তু তার কমিটির সদস্যরা দোকানদার না হয়েও কমিটির সদস্য হয় এবং পেশিশক্তির জোরে আসল কমিটির নেতাদের মার্কেট থেকে বের করে দেন শাহাবুদ্দিন। পরে নিজের অনুগতদের নামে দোকান বরাদ্দ দিয়ে নিজেই মার্কেট পরিচালনা করেন।
জানা যায়, ২০১৫ সালে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মার্কেটে ভুয়া ক্ষতিগ্রস্ত হকার বানিয়ে ৫৯০টি দোকান বরাদ্দ নিয়ে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ক ও খ ইউনিটের বৈধ সমিতির সদস্যদের মার্কেট থেকে বের করে দিয়ে সেটি দখল করে নেন শাহাবুদ্দিন। এর পর সেই দোকানগুলো বিক্রি করে হাতিয়ে নেওয়া হয় অর্ধশত কোটি টাকা। এ ছাড়া ২০১৬ সালে সুন্দরবন স্কোয়ার মার্কেটের ফুটপাতে নির্মিত ৫০টি দোকান ও গুলিস্তান টিঅ্যান্ডটি ভবন সংলগ্ন ফুটপাতে ৭০টি দোকান নির্মাণ করে প্রায় ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন শাহাবুদ্দিন। পরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সিটি করপোরেশন সেগুলো ভেঙে ফেলতে বাধ্য হয়। সূত্র: আমাদের সময়