ডিপিডিসির ভূ-গর্ভস্থ ক্যাবেলিং কাজে লোপাট: প্রকল্প পরিচালক বদরুল নিজেই বিদেশীদের এজেন্ট!

- ১-Oct-২০১৯ ১০:২৪ পূর্বাহ্ণ
::উৎপল দাস::
ভূ-গর্ভস্থ বিতরণ লাইন স্থাপনের কাজে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থা ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পে নকশার ব্যতয় ঘটিয়ে সম্পন্ন করা হয়েছেন ১১ কে.ভি গুরুত্বপূর্ণ এই বিতরণ লাইনের কাজ। একই সঙ্গে এই বিদেশি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট হিসেবে কাজ করার অভিযোগ উঠেছে প্রকল্প পরিচালক (পি.ডি) ডিপিডিসির এক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে।
ডিপিডিসি সূত্রে জানা যায়, নতুন বিতরণ লাইন নির্মাণ, বিতরণ লাইনের আধুনিকায়ন ও সম্প্রাসারণের লক্ষ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অন্তভূক্ত (বিদেশি অর্থায়ন) কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড এক্সপ্যানশন অব ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক অব নর্থ অ্যান্ড সাউথ জোন আন্ডার ডিপিডিসি শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেয় বিতরণকারী সংস্থাটি। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), বাংলাদেশ সরকার ও ডিপিডিসির নিজস্ব অর্থায়নে মোট ৩৬৭ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা চুক্তিমূল্যে এই প্রকল্পের কাজ দেওয়া হয় ভারতীয় প্রতিষ্ঠান মেসার্স এনজেলিক ইন্টারন্যাশনালকে। আর এই কাজে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া ডিপিডিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল ফজল মো. বদরুল আলমকে। প্রকল্পে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন হরিচাঁদ হালদার ও মো. ফয়েজ করিম। ডিপিডিসি সূত্রে জানা যায়, এই প্রকল্পের আওতায় ১১ হাজার ৬০০ টি বিতরণ পোল, ১ হাজার ৭০০টি ১১/০.৪ কেভি ২৫০ কেভিএ ডিস্ট্রিবিউশন ট্রান্সফর্মার স্থাপন, ১১৭ কিলোমিটার ১১ কেভি, ১২৬ কিলোমিটার ১১/০.৪ কেভি ও ১৯০ কিলোমিটার ০.৪ কেভি ওভারহেড লাইন নির্মাণ এবং ১৫৫ কিলোমিটার ১১ কেভি আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবল স্থাপনের কাজ করা হয়েছে।
এদিকে, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে বিদেশী দাতা সংস্থা অর্থায়নে ডিপিডিসির এসব উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করেয়ে নিয়ে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের একটা শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে সেবা প্রদানকারী এই সংস্থাটিতে। কেননা বিদেশী ঠিকাদারদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিলে নিয়মিত বিদেশ সফরে যাওয়া যায় এবং সেখানে গিয়ে কৌশলে কমিশনের টাকাগুলো বিদেশের ব্যাংকেই সেই টাকা গচ্ছিত রাখছেন। এমনকি ডিপিডিসির কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মিলে গড়ে তুলেছেন অশুভ একটি সিন্ডিকেট। যেই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তারা নিজেদের পছন্দ মতো বিদেশি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে দিচ্ছেন। সুকৌশলে দ্বৈত নাগরিকত্ব বাগিয়ে নেয়া চতুর এইসব কর্মকর্তারা বিদেশে আয় করার দেশের প্রকল্পের টাকা বিদেশেই রেখে আসছেন। সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক ডিপিডিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল ফজল মো. বদরুল আলম নিজেও সেই অশুভ সিন্ডিকেটের একজন সদস্য মাত্র। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা হিসাবে রয়েছেন ডিপিডিসির ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী (উন্নয়ন) ফেরদৌস। মাত্র তিন মাস আগে দায়িত্ব পেয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই বিদেশি ঠিকাদারদের প্রতি প্রীতি অনেক বেড়ে গেছে। নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় তিনি দেশীয় অনেক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা থাকার পরও তাদের কাজ দেয়া হচ্ছে না।
স্থানীয় (দেশীয়) বেশ কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অভিযোগে জানা যায়, ফরেন এইডে (বিদেশি অর্থায়ন) ডিপিডিসি’র আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবেলিংয়ের কাজে শুধুমাত্র দুর্নীতি লক্ষ্যে বিদেশী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ করানো হয়। অথচ, এডিপি বহির্ভূত একই ধরণের কাজে দেশিয় প্রতিষ্ঠান সফলতার সঙ্গেই কাজ করছে। তাদের অভিযোগ, নামে মাত্র বিদেশি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হলেও, মূল প্রকল্পের কাজ করছে ডিপিডিসি’র সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালকের নেতৃত্বে সংস্থার অন্যান্য প্রকৌশলীরা। প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষভাবে প্রকল্প পরিচালকই বিদেশি ঠিকাদারি প্রতষ্ঠানের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন।
ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিযোগ, জনদূর্ভোগ এড়াতে আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবেলিংয়ের এই কাজ গভীর রাতে করার নিয়ম থাকায়, কাজে অনিয়মের সুযোগ পায় প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে এক সঙ্গে কয়েক কিলোমিটার সড়ক খুড়ে রাখলেও, ক্যাবল স্থাপনের কাজ করা হয় এক রাতেই। নকশা অনুযায়ী, আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবেলিংয়ের কাজে মাটি খুঁড়ে চার ইঞ্চি পরিমাণ বালু ভরাট করে তার উপর ক্যাবল স্থাপন করে তা আবারও বালু দিয়ে ঢেকে দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। অথচ এই প্রকল্পে মাটি খোঁড়ার পর নিচে কোনো বালু না বিছিয়েই ক্যাবল স্থাপন করে উপরে যৎসামান্য বালু ফেলে তা পুনরায় মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলা হয়েছে।
তবে প্রকল্পে কোনো ধরণের অনিয়ম বা দুর্নীতি ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেছেন প্রকল্প পরিচালক ডিপিডিসি’র তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল ফজল মো. বদরুল আলম। একই সঙ্গে ভারতীয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স এনজেলিক ইন্টারন্যাশনালের এজেন্ট হওয়ার সুযোগ নেই বলেও জানান তিনি। বিদেশ সফরে গিয়ে বিদেশে টাকা রেখে রাখার বিষয়টি সরাসরি অস্বীকার করার পাশাপাশি তিনি অশুভ সিন্ডিকেটের সাথেও জড়িত নন বলে দাবি করেন।
তিনি বলেন, প্রজেক্ট-১ এর আওতাধীন এই প্রকল্পে কোনো ধরণের অনিয়মের ঘটনা ঘটেনি। আমাদের (ডিপিডিসি) প্রকৌশলীদের যথাযথ তদারকির কারণে কাজে কোনো প্রকার অনিয়ম ও কারচুপির সুযোগ দেওয়া হয়নি এনজেলিক ইন্টারন্যাশনালকে। আমাদের দেশের কাজে বিদেশি কোম্পানি যাতে কোনো প্রকার গাফিলতি করতে না পারে সেদিকে আমরা কঠোর নজরদারি করেছি। আর এই প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশি এজেন্ট হওয়ার তো কোনো সুযোগই ছিল না। কারণ বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব কার্যালয়ের পাশাপাশি অর্ধ শতাধিক নিজস্ব প্রকৌশলীও রয়েছে। সেক্ষেত্রে কেনো তারা ডিপিডিসির প্রকৌশলীদের এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিবে।
তবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় পান্থপথ-গ্রীন রোড এলাকায় সংস্থার আরও দুটো প্রকল্পের কাজ একই সঙ্গে চলমান থাকায় ওই অঞ্চলে কাজে কিছুটা বিলম্ব ঘটে বলেও জানান এই প্রকল্প পরিচালক। তিনি বলেন, ডিপিডিসির নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে কাওরানবাজার থেকে স্কয়ার হাসপাতাল পর্যন্ত আরেকটি আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবল স্থাপনের কাজ চলমান ছিল। ওই কাজটি উত্তর ও দক্ষিণ দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যেই পড়ে, কিন্তু ভুলবশত শুধুমাত্র উত্তর সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে রাস্তা খননের অনুমতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কাজ করার সময় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে বাঁধা আসে। পরে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অনুমতি নেওয়ার পর বাকি কাজ শেষ করা হয়। এই জটিলতার কারণে তিনটি প্রকল্পের কাজই কিছুটা বিঘ্নিত হয় এবং সময়মত নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করা সম্ভব হয়নি। ওই সময় আমাদের প্রকল্পের জন্য যে রাস্তা খোঁড়া হয়েছিলো তা বেশ কয়েকদিন পড়ে থাকে। এতে অনেকেরই মনে হতে পারে নিচে বালুর স্তর দেওয়া হয়নি।
তবে এমন জটিলতার কথা অস্বীকার করেন নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, আমার প্রকল্পটি ওই অঞ্চলের মধ্যেই ছিল না। আর ওই সময় সেখানে অন্য কোনো প্রকল্পের কাজও চলছিলো না।
এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান বলেন ফোন করা হলেও তার ব্যবহৃত ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
ডিপিডিসির বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রসঙ্গে কনজুমার অ্যাসোসিয়শন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ নতুন কিছুই নয়। দুর্নীতি এই খাতের রন্ধ্রে, রন্ধ্রে স্তরে স্তরে ঢুকে গেছে। বিদেশি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজ করলেই যে দুর্নীতির সুযোগ নেই এমন কথার যুক্তি নেই। বরং আরও সুবিধাই হয়। যারা তদারকি করবেন, তারা যদি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ দেন তাহলে কেনো তারা নিবেন না সে সুযোগ। এতে তো তাদেরও লাভ। আর কাজ শেষের পর তারা টাকা নিয়ে চলে যাবে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ আগেও হয়েছে, এসব অভিযোগে সংস্থাগুলো তদন্তও করে। কিন্তু বাস্তবে কোনো তদন্তের ফলাফল আমরা দেখি না। এসব অভিযোগ সংস্থাকে নয়, মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন স্টকহোল্ডারদের সমন্বয়ে কমিটি করে তদন্ত করা উচিত। সেক্ষেত্রে প্রকৃত ঘটনা উঠে আসবে।
এদিকে, প্রথমবার বক্তব্য জানার জন্য ডিপিডিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল ফজল মো. বদরুল আলমকে মঙ্গলবার বিকাল ৪ টায় এ প্রতিবেদক ফোন করলেও মাত্র ৩৭ সেকেন্ডে নিজের অবস্থান পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরতে পারেননি ব্যস্ততার কারণে। পরে ৪ টা ১৭ মিনিটে তিনি নিজেই কল ব্যাক করে বলেন, আমার বিরুদ্ধে উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে একটি মহল এসব ছড়াচ্ছে। তিনি এ প্রতিবেদককে কাগজপত্র দেখতে তার অফিসে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এমনকি তিনি বলেছেন, প্রকল্পটি ৫৯৬ কোটি টাকার হলেও ৮৮ কোটি টাকা কমেই করা হয়েছে এবং সব নিয়ম মেনেই করা হয়েছে।
আগামী পর্বে: ডিপিডিসি লোপাটের মূল হোতা পরিচালক (অপারেশন) হারুনুর রশীদ, পরিচালক (প্রশাসন) জয়ন্ত কুমার শিকদার , তত্ত্ববধায়ক প্রকৌশলী (ক্রয় ও চুক্তি) মর্তুজার দুর্নীতির আদিঅন্ত!