ঘুষের রাজ্য গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ! (পর্ব-২)

- ২-Oct-২০১৯ ০৪:১২ অপরাহ্ন
উৎকোচ বাড়ায় ফাইলের গতি!
:: জিএম রফিক ::
গত রোববারের ঘটনা। ষাটোর্ধ্ব রহিমা খাতুন (ছদ্মনাম) বসে ছিলেন জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের তৃতীয় তলায়। মোহাম্মদপুরের একটি জমি মিউটেশন (নামজারি) করাতে শ্যামলী থেকে এসে সকাল থেকে বসে ছিলেন তিনি। দুপুর ১২টার দিকে তার কাছে এলো ৩০-৩৫ বছরের এক ব্যক্তি। অল্প আওয়াজে কিছু বললেন। বৃদ্ধা একটি খাম তুলে দিলেন তার হাতে। পরে রহিমা খাতুনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এর আগেও একাধিকবার এই কাজে সেখানে এসেছেন তিনি। কিন্তু ফাইল নড়েনি। কারণ তার কাছে কোনো টাকা ছিল না। এবার তার মেয়ে জামাই জমির ভাগ বুঝে নেওয়ার শর্তে কিছু টাকা দিয়েছে। সেই টাকা নিয়েই তিনি এসেছেন নামজারি করাতে। সঙ্গে তার মেয়েও বসা। তিনি বলেন, ‘বৃদ্ধ মা। তাকে নিয়ে এতো টানা হ্যাচড়া কার ভালো লাগে। তারপরও বারবার আসতে হয় দেখে কিছু টাকা দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছি।’
শুধু রহিমা খাতুনই নয়, সেখানে বসে থাকা সবার কাছেই যেন ‘ওপেন সিক্রেট’। তারা গল্প করছিলেন, ‘কার কতো লাগলো, কোন দাদালের কাজ ভালো, কাকে বিশ^াস করে টাকা দিলে কাজ মার যাওয়ার সম্ভাবনা নেই’ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। তাদের গল্পের মধ্য দিয়েই জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী ফাইল জমা দিলে তা জমাই থেকে যায়। নড়ে না। ফাইল জমা দেওয়ার আগেই দালালরা যেন বুঝে ফেলেন সব। প্রস্তাব করে বসেন টাকার বিনিময়ে কাজ করে দেওয়ার। এমনই একটা সবুজ রঙের ফাইল কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছলো গল্প করছিলেন যারা তাদের একজনের হাতে। তখন দুপুর দুইটা। ফাইল পেয়ে চেহারায় হাসি ফুটে ওঠা ওই ব্যক্তি যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ‘দেখেছেন, বললাম না ইনি ‘ওমুক’ স্যারের লোক। মিস যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।’ সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন তার কাছ থেকে নিয়ে নিলেন ওই ‘ওমুক স্যারের লোক’-এর নম্বর। এই প্রতিবেদকের সহকারীও তার কাছ থেকে নম্বর নিলেন। ওই নম্বরে ফোন দেওয়া হলো আধা ঘণ্টা পর। সব জানার পর ওপাশ থেকে বলা হলো, ‘আজ কাজ হবে না। স্যার মন্ত্রণালয়ে গেছেন। কাল টাকা সঙ্গে করে সকাল সকাল আসেন। হয়ে যাবে।’ ফ্ল্যাটভিত্তিক সেল পারমিশন বাবদ তিনি চাইলেন ১৫ হাজার টাকা। ‘একটু কম হবে না ভাই?’ প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, ‘দ্রুত কাজ চাইলে যা বলেছি তাই করেন।’ এরপর আর দেরি না করে লাইন কেটে দেওয়া হলো ওপার থেকে।
এর মধ্যে রহিমা খাতুনের ফাইলও এসে গেলো। তার চোখেমুখে তখন বিজয়ের হাসি। যাওয়ার সময় তিনিও পরামর্শ দিলেন, ‘আমি যাকে দিয়ে করিয়েছি, তাকে দিয়ে কাজ করাতে পারো বাবা। টাকা ছাড়া কিছুই হবে না।’ তার সঙ্গে যোগাযোগ কীভাবে করবো বলতেই তিনি বললেন, ‘তাকে সবাই চেনে। তিনি নেতা মানুষ। খুব ভালো মানুষ। এক নিমিষেই কাজ করে দেন।’
পর দিন সোমবার সকালেই ফোন দেওয়া হলো ‘স্যারের লোককে। তিনি বললেন, ‘এসেছেন? ক্যান্টিনের সামনে আসেন।’ সেখানে গিয়ে স্যারের লোককে খুঁজে পাওয়া গেলো। তখন তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে চার-পাঁচজন। সবার হাতেই ফাইল। তিনি বললেন, ‘একটা কাগজে মোবাইল নম্বর লিখে টাকা দিয়ে চলে যান। তিন দিন পর যোগাযোগ করবেন।’ এই প্রতিবেদকের সহকারীকে দেখে ডেকে নিলেন কাছে। কয়েকটি কথার পর বললেন, ‘কাজ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করছেন কেন? আমার নাম বললেই সবাই চিনবে। এক নামে চেনে আমি কার লোক। টাকা দেন, ফাইল দৌড়াবে গুলির মতো।’ পরে ‘চার হাজার টাকা কম আছে। ম্যানেজ করে আসছি’ বলে চলে আসে প্রতিবেদক সহকারী।
এর আগে ভোরের পাতা দফতরে দলিলপত্রসহ অভিযোগ আসে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, কর্মচারী, তাদের সহধর্মিনী, বেনামীতে আত্মীয়-স্বজনদের নামে কেনা কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির তথ্য। আর গতকাল মঙ্গলবার ভোরের পাতায় সংবাদ প্রকাশের পর জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে চলে সর্বদা গুঞ্জন, কানাঘোষা। সরেজমিনে গিয়ে পাওয়া যায় আরও কিছু তথ্য। আর জানা যায় ভয়ঙ্কর নতুন কিছু ঘটনার অন্তরালের ঘটনা। এতোদিন যারা মুখ খুলছিলেন না, তারাও জানায় তাদের দুঃখ-বেদনার কথা। তবে গতকাল দালালরা ছিল বেশ আড়ালে।