দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ দুবাইয়ে গ্রেপ্তার

- ৩-Oct-২০১৯ ১০:০৫ অপরাহ্ন
:: ভোরের পাতা ডেস্ক ::
দুবাইয়ে অবস্থানকারী দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাতে বাংলাদেশ ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (যা ইন্টারপোলের সাথে যোগাযোগ করে) সহায়তায় দুবাই কর্তৃপক্ষ তাকে আটক করেছে।
জিসানকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন। গতকাল তিনি বলেন, ইন্টারপোলের মাধ্যমে আনঅফিসিয়ালি তিনি জিসানের গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে পেরেছেন। তবে দুবাইয়ে সংঘটিত কোনো অপরাধের কারণে না কি ইন্টারপোলের দাগি আসামি হিসেবে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তিনি।
সাম্প্রতিক অভিযানে অবৈধ ক্যাসিনো কারবারের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে যখন জিসান সম্পর্কে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে, ঠিক তখন এ শীর্ষ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করার সংবাদ জানা গেল।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দিবিনিময় চুক্তি নেই। তাই চাইলেও তাকে দেশে ফেরাতে পারবে না ঢাকা। পাসপোর্টসূত্রে ভারতের নাগরিক জিসানকে ভারতে ফেরত পাঠানো হলে বাংলাদেশ তাকে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চালাতে পারে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, জিসান ইন্টারপোলের দাগি আসামি। বাংলাদেশে পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী। তাকে গ্রেপ্তারে বছরখানেক আগে ইন্টাপোলের সহযোগিতা
চেয়েছিল বাংলাদেশ পুলিশ। এ নিয়ে কয়েক দফা চিঠি চালাচালিও হয়। ধারণা করা হচ্ছে, ইন্টারপোলের তথ্যের ভিত্তিতেই দুবাই পুলিশ জিসানকে গ্রেপ্তার করে থাকতে পারে।
জিসান দীর্ঘদিন ধরে দুবাইয়ে অবস্থান করছেন। সেখানে বসেই দেশের অপরাধ জগতের অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। ক্যাসিনোকা-ে সম্প্রতি বেশ কয়েকজন যুবলীগ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে তারা জিসানের নামে অপরাধ জগতের অনেক অজানা তথ্য দিয়েছেন। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ‘টেন্ডারবাজ’ যুবলীগ নেতা জিকে শামীম তারই লোক। তার মাধ্যমেই দুবাইয়ে বসে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন জিসান।
জানা গেছে, জিসানের বিষয়ে ইন্টারপোলের সঙ্গে চিঠি চালাচালি শুরু করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট স্পেশাল উইপনস্্ অ্যান্ড ট্যাকটিস (সোয়াত)। ইন্টারপোলের সবুজ সংকেত পেলে পুলিশের একটি প্রতিনিধি দল দুবাই যেতেও প্রস্তুত।
২০০৩ সালের ১৪ মে ঢাকার মালিবাগে জিসানকে গ্রেপ্তারের অভিযানকালে তারই সহকর্মীদের ব্রাশফায়ারে নিহত হন ডিবি পুলিশের দুই কর্মকর্তা। তৎকালে ওই হত্যাকা-ে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। অপারেশন ক্লিনহার্ট চলাকালে ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নান নিহত হলে জিসান ভারতে পালিয়ে যান। সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে দুবাইয়ে পাড়ি জমান।
দুবাই অবস্থানের জন্য নাম-পরিচয় পাল্টে জিসান তৈরি করেন প্রতিবেশী দেশ ভারতের পাসপোর্ট। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান নিজের নাম বদলে আলী আকবর চৌধুরী নামে ভারতীয় পাসপোর্ট গ্রহণ করেন। ভারতীয় নাগরিক হিসেবে ঠিকানা দেখিয়েছেন শারদা পল্লী, ঘানাইলা, মালুগ্রাম শিলচর, চাষার, আসাম। বাবার নাম হাবিবুর রহমান চৌধুরী ও মায়ের নাম শাফিতুন্নেছা চৌধুরী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর স্ত্রীর নামের স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে রিনাজ বেগম চৌধুরী। পাসপোর্ট ইস্যুর স্থান দুবাই হিসেবে উল্লেখ রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জিসানকে মূলত বাংলাদেশি পুলিশের গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে দুবাই পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। কারণ জিসানের সম্প্রতি সময়ের বেশ কিছু কর্মকা- ঘিরে তার ওপর বিভিন্ন মাধ্যমে গোয়েন্দা নজরদারি শুরু করে বাংলাদেশি পুলিশের একটি বিশেষ ইউনিট। আর জিসানের কোনো হালনাগাদ ছবি না থাকায় ইন্টারপোলও এক প্রকার অন্ধকারে ছিল। এ ছাড়া ভারতীয় পাসপোর্ট গ্রহণ করায় দেশের গোয়েন্দাদেরও টার্গেটে ছিল জিসান।
তবে জিসানের হাতে ভারতীয় পাসপোর্ট থাকায় তাকে সরাসরি বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেখছেন না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। তারা মনে করেন, তাকে প্রথমে ভারতে নিতে হবে। ভারত থেকে বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সহায়তা চাইবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুবাইয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের দুটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। সেখানে তার গাড়ির ব্যবসাও রয়েছে। এই ব্যবসা দেখভাল করেন তার আপন ছোটভাই শামীম ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শাকিল মাজহার। মাজহার সূত্রাপুর যুবলীগ দক্ষিণের সহসম্পাদক রাজিব হত্যাকা-ের আসামি। রাজিব হত্যার পর পালিয়ে দুবাই যান তিনি।
সূত্র জানায়, জিকে শামীমকে ঘিরে ঢাকা মহানগর যুবলীগের এক শীর্ষ নেতার বিরোধ তৈরি হয়। এই সিন্ডিকেটের ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন আরেক যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। বিরোধের একপর্যায়ে জিসান ক্ষুব্ধ হন তাদের ওপর। অবস্থা ভিন্ন দিকে যাওয়ার আশঙ্কায় জিসানের সঙ্গে বিরোধ মেটাতে সমঝোতা বৈঠকের আয়োজন করেন খালেদ। গত জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে সিঙ্গাপুরে যান জিকে শামীম, মহানগর যুবলীগের ওই শীর্ষ নেতা এবং খালেদ। আর জিসান দুবাই থেকে সিঙ্গাপুরে যান। সিঙ্গাপুরে মেরিনা বে এলাকার একটি বিলাসবহুল হোটেলে তাদের বৈঠক হয়। তবে তাদের কাক্সিক্ষত ফল ছাড়াই দেশে ফিরতে হয়। এমন প্রেক্ষাপটে কিলিং মিশিনে অংশ নিতে দুবাই থেকে ঢাকায় আসেন জিসানের সহযোগীরা।
গত ২৬ জুলাই রাতে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে বিদেশি অস্ত্র, গুলিসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- খান মোহাম্মদ ফয়সাল (৩৮), জিয়াউল আবেদীন ওরফে জুয়েল (৪৫) ও মো. জাহিদ আল আবেদিন ওরফে রুবেল (৪০)। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি একে ২২ রাইফেল, চারটি বিদেশি পিস্তল, একটি বিদেশি রিভলবার ও ৪৭টি গুলি উদ্ধার করা হয়। একে২২ রাইফেলটি আমেরিকার তৈরি অটোমেটেড।
তখন ডিবি পুলিশ জানিয়েছিল, গ্রেপ্তারকৃত তিনজনের মধ্যে দুজন শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সহযোগী। তারা দুবাই থেকে একটি বিশেষ কিলিং মিশনে অংশ নিতে ঢাকায় আসেন। এ নিয়ে ডিবি পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও তারা জিসানের পরিকল্পনার তথ্য তুলে ধরেছেন বলে জানিয়েছে ডিবির ওই সূত্র।
র্যাবের হাতে ৭ অস্ত্রধারী দেহরক্ষীসহ গ্রেপ্তার হন জিকে শামীম। গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জিকে শামীমও জানিয়েছেন, তিনি আগে কখনো এত দেহরক্ষী রাখেননি। মূলত জিসানের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হওয়ার পর থেকে ‘ভয়ে’ বড় নিরাপত্তা টিম গঠন করেন এই টেন্ডারবাজ।