অবাধে চলছে লক্ষাধিক ফিটনেসবিহীন গাড়ি

- ২-Nov-২০১৯ ১২:২৩ অপরাহ্ন
গাড়ি মালিকদের আগ্রহ নেই নবায়নে, ১০০ কোটি টাকা রাজস্ব পাওনা বিআরটিএর
:: আরিফুর রহমান ::
রাজধানীসহ সারা দেশে প্রকাশ্যেই চলাচল করছে লক্ষাধিক ফিটনেসবিহীন বাস, ট্রাক ও লরি। এসব গাড়ির বর্তমান বাজারমূল্যের চেয়েও অতিরিক্ত টাকা রাজস্ব দেনা রয়েছে বিআরটিএতে।
বিআরটিএর এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, গত বছর ছিল ৫২ হাজারের বেশি ফিটনেসবিহীন গাড়ি। এই বছরও নতুন পরিসংখ্যানে এসে দাঁড়িয়েছে ৫৫ হাজারের বেশি। এতে দেখা যায়, ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়ছে। বিআরটিএর গড় হিসাবে ফিটনেসবিহীন গাড়ির মালিকদের কাছে বিআরটিএর ১শ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব পাওনা রয়েছে। অথচ এসব গাড়ি রাতের বেলায় রাজধানীসহ সারা দেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিনা বাধায়। বছরের পর বছর রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে চলা গাড়িগুলোর কাছ থেকে রাজস্ব আদায় নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীসহ আশপাশের সড়ক-মহাসড়কে রাতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ফিটনেসবিহীন কয়েক হাজার ট্রাক ও লরি। এসব গাড়ির কাগজপত্রের মেয়াদ প্রায় দুই যুগ আগে শেষ হয়ে গেলেও এখনো নির্বিঘ্নে রাস্তায় চলাচল করছে। অভিযোগ রয়েছে, পরিবহন নেতা ও এক শ্রেণির ট্রাফিক পুলিশ কর্তার ইশারায় গাড়িগুলো রাস্তায় চলাচল করছে। আরও দেখা গেছে, রাজধানীতে চলাচলরত অধিকাংশ ফিটনেসবিহীন গণপরিবহন রং বদল করে ও জোড়াতালি দিয়ে ফিটনেস ও কাগজপত্র নবায়ন করার প্রক্রিয়া চলছে। অপেক্ষাকৃত কম ফি লাগবে- এমন গাড়িগুলো জোড়াতালি দিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজ নবায়ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন অনেকে।
রাজধানীর একটি পরিবহন কোম্পানির অধীন কমলাপুর থেকে গুলশান রুটে কয়েকশ বাস রাস্তায় চলাচল করে। এ কোম্পানির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ গাড়ির কাগজপত্রের মেয়াদ প্রায় দুই যুগ আগে শেষ হয়েছে। বর্তমানে একটি গাড়ির কাগজ নবায়ন করতে বিআরটিএতে সরকারি রাজস্ব ও জরিমানা বাবদ প্রায় ২৭ লাখ টাকা জমা দিতে হবে। অথচ এই গাড়িটির বর্তমান বাজারমূল্য মাত্র ৬ লাখ টাকা বলে জানিয়েছেন গাড়ির মালিক শাহ আলম। এ অবস্থায় এত টাকা কীভাবে পরিশোধ করবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি। শুধু শাহ আলমই নন, তার কোম্পানির অধিকাংশ গাড়িরই এমন করুণ দশা।
‘এতদিন টাকা পরিশোধ করেননি কেন’- এ প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নে তিনি খানিকটা থমকে গিয়ে বলেন, ‘রাস্তায় প্রতিদিন টাকা দিয়ে গাড়ি চালিয়েছি। কিন্তু এমন পরিণতি হবে তা বুঝতে পারিনি।’
এদিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে উৎসব, হিমাচল, বন্ধনসহ আরো কিছু পরিবহন চলাচল করে দীর্ঘদিন যাবত। এসব পরিবহনের মালিকের সঙ্গে কথা হলে তাড়া এ প্রতিবেদককে জানান, ‘টাকা হলে এদেশে সব সম্ভব। লাখ লাখ টাকা দিয়ে কেন কাগজ নবায়ণ করতে যাব বিআরটিএতে। দীর্ঘদিন যাবত আমাদের গাড়ি মানুষদের গণসেবা দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে অধিকাংশ গণপরিবহনে সব কাগজপত্র থাকে না। আমাদের দরকার সরকারের বিআরটিএ এবং বিভিন্ন পুলিশের নাম এবং মোবাইল নাম্বার। তাদের ফোন করলে রুটে কোনো সমস্যা থাকলে তা সমাধান হয়ে যায়।’
তারা আরো বলেন, ‘বিভিন্ন মিডিয়ায় বহু নিউজ হয় গণপরিহন নিয়ে তা আমরা দেখি। কয়েকদিন গেলেই আবার সব আগের অবস্থায় ফিরে আসে। আসলে গাড়ি হিসাব করার আগে চালকদের লাইসেন্স দেখা দরকার বলে মন্তব্য করেন একাধিক বাসমালিক। আমাদের তো কিছু কিছু গাড়ির কাগজের সমস্যা, অধিকাংশ পরিবহনে চালকদের তো লাইসেন্সই নেই’।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মফিজ উদ্দিন আহমেদ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি কিছুদিন হলো দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। শুনেছি বহু পুরনো গাড়ি নতুন করে মাঠে নামানোর চিন্তাভাবনা করছেন পরিবহন মালিকরা। অনেক গাড়ির ফিটনেস ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও নেই।’ গত বছরে শেষে এবং নতুন বছরের শুরু থেকে একের পর এক আন্দোলনে সড়কে অস্থিরতা থাকায় সেই সময় গাড়িগুলো জোড়াতালি ও রং করে চকচকে করা শুরু করা হয়। অনেক পরিবহন মালিকের ১০টি গাড়ির রুট পারমিট থাকলেও বিভিন্ন নামে ৪০-৫০টি গাড়ি চালানোর অভিযোগ রয়েছে।
মফিজ উদ্দিন আরো বলেন, ‘আমরা চাই কাগজপত্রবিহীন এসব পরিবহন যেন কোনোভাবেই রাজধানীতে প্রবেশ করতে না পারে; সে বিষয়ে আমাদের ট্রাফিক বিভাগ সার্বক্ষণিক নজরদারি রেখেছে। যত চকচকেই হোক না কেন কোনো গাড়ির রুট পারমিট, ফিটনেস ও লাইসেন্স ছাড়া কোনোভাবেই রাস্তায় চলতে দেওয়া হবে না।’ বিআরটিএ ইকুরিয়া কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি.) মো. হারুন-অর-রশিদ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘রাজধানীতে চলাচলরত ডেট ফেল কোনো গাড়ির কাগজপত্র নবায়ন করতে এখনো আমাদের কাছে আসেনি।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ ‘বিআরটিএ’র চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব মো. আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বর্তমানে যেসব রুট পারমিট আছে- এমন গাড়ির মালিক সমিতির লোকেরা একটি কমিটি গঠন করে আমাদের কাছে পাঠালে আমরা তা গ্রহণ করি। পরিবহন মালিকদের যে পরিমাণ গাড়ির রুট পারমিট আমরা দিয়ে থাকি তার চেয়ে অধিক গাড়ি রাস্তায় চালালে আমরা তা দেখতে পারব না। সে জন্য ট্রাফিক বিভাগ রয়েছে।’ ফিটনেসের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের কিছু সমস্যা হয়তো থাকতে পারে; সেই জন্য কিছুটা অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছিল। এখন আমরা এ বিষয়ে প্রতিনিয়ত নজর রাখছি।’
এই বিষয়ে বিআরটিএর পরিচালক (অপারেশন) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এখনো শত কোটি টাকার ওপরে বাস মালিক আমাদের কাছে রাজস্ব দেনা। আমরা অনেক সুযোগ দিয়েছি কিন্তু আর না। আমরা এখন নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। তাছাড়া আমরা নিয়মিত বাস মালিক সমিতির সঙ্গে বৈঠক করে রাজস্ব দেনার বিষয়ে জানিয়েছি। এই বছরের মধ্যেই আশা করা যায় তাদের (বাস মালিকদের) কাছ থেকে পুরোপুরি রাজস্ব আদায় করতে পারব।’
এই বিষয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান ড. মো. কামরুল আহসান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘অতীতে অনেক সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা সেই সুযোগ গ্রহণ করতে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে। পূর্বের তুলনায় বিআরটিএ অনেক সচেতন। আমরা আশা করি, ফিটনেসবিহীন যত গাড়ির মালিক আছেন তারা নবায়ন করে যাবেন। এতে এক দিকে সরকার লাভবান হবে; অন্যদিকে রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে।’