ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন:উত্তর ও দক্ষিণ কমিটিতে নতুন মুখের পক্ষে কেন্দ্র ও তৃণমূল

- ২৮-Nov-২০১৯ ১২:০২ অপরাহ্ন
::আরিফুর রহমান::
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের ভেতরে ও বাইরে শুদ্ধি অভিযান শুরু করায় পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। প্রধানমন্ত্রীর এই সাহসী পদক্ষেপে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তার সব কটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনেরও ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে দলের ত্যাগী, নীতি আদর্শবান ও ক্লিন ইমেজের নেতা-কর্মীদের এখন মূল্যায়নের সময় এসেছে। ফলে দলে অনুপ্রবেশকারী, নবাগত, ভুঁইফোঁড় ও অবৈধ অর্থ-বিত্তের মালিক বনে যাওয়া নেতা-কর্মীরা ইতোমধ্যেই গা ঢাকা দিয়েছে এবং সামনের কাতারে উঠে আসছেন ত্যাগী, সৎ, আদর্শবান ও কর্মীবান্ধব নেতারা। দলীয় হাই কমান্ড থেকে বিতর্কিত এবং অনুপ্রবেশকারীদের বাদ দিয়ে ‘ক্লিন’ ইমেজের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের নিয়ে সুন্দর কমিটি গঠন করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশ অনুসরণ করে ইতোমধ্যেই পরিবর্তন করা হয়েছে ছাত্রলীগের কমিটি। কৃষকলীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্মেলনের মাধ্যমে ব্যাপক পরিবর্তন ও নেতৃত্বে নতুন মুখ আসায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা নতুন করে আশাবাদী হয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে ঘিরেও কমিটির ব্যাপক পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণের সম্মেলন আগামী শনিবার ৩০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
এই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ ও কেন্দ্রীয় কমিটির বিশেষ সেল সম্ভাব্য নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে সব ধরনের খোঁজখবর সংগ্রহ করেছে। সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান কমিটি ও যারা আগামী নেতৃত্বে আসতে পারেন তাদের সবার বায়োডাটা দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে রয়েছে। তার ইশারা ইঙ্গিতেই নতুন কমিটির নেতৃত্ব নির্ধারণ হবে। বিশেষ করে ঢাকা মহানগরী উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নতুন কমিটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। তিনি ইতোমধ্যেই নেতাদের বিগত দিনের আমলনামা সংগ্রহ করে বিতর্কিত, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জড়িত ও অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা করে তাদের দল থেকে বিদায় করার জন্যও নির্দেশ দিয়েছেন।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র এবং আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের একজন সিনিয়র নেতা এ প্রতিবেদককে জানান, ‘যাদের কারণে বিগত দিনে দল ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে, যারা নানা অপকর্মে লিপ্ত থাকার মধ্য দিয়ে দলকে বিতর্কিত ও বিব্রত করেছেন, এবং সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছেন, এবং যারা দলের নাম ভাঙিয়ে রাতারাতি বাড়ি, গাড়ি ও অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন, তারা কেউ-ই মহানগর আওয়ামী লীগের কোনো কমিটিতে স্থান পাবেন না, এটা জননেত্রী শেখ হাসিনার সুষ্পষ্ট নির্দেশ।’ ২০১২ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগরী আওয়ামী লীগের সর্বশেষ ত্রিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর ৩ বছর পর ২০১৬ সালের ১০ এপ্রিল ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগকে উত্তর ও দক্ষিণে দুই ভাগে বিভক্ত করে পূর্ণাঙ্গ কমিটির ঘোষণা করা হয়।
আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মহানগর দুই অংশের ৪৫ টি থানা, ১০০টি ওয়ার্ড ও ইউনিয়নের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করেন। এই কমিটিতে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তরের সভাপতি করা হয় একেএম রহমতুল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক করা হয় মোহম্মদপুর এলাকার সাদেক খানকে। আর দক্ষিণে সভাপতি করা হয় পুরান ঢাকার হাজি আবুল হাসনাত ও সাধারণ সম্পাদক করা হয় শাহে আলম মুরাদকে। এ বছর গত ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের পূর্ণাঙ্গ কমিটিও ঘোষণা করা হয়।
মোহম্মদপুর এলাকার দীর্ঘদিনের ওয়ার্ড কমিশনার উত্তরের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান এমপি এবার মহানগর উত্তরের শক্তিশালী সভাপতি প্রার্থী। কর্মীবান্ধব নেতা হিসাবে যথেষ্ট সুনাম রয়েছে তার। এছাড়া, বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি শেখ বজলুর রহমানও সভাপতি প্রার্থী বলে তার নিজস্ব লোকজন প্রচারণা চালাচ্ছেন। শেখ বজলুর রহমান ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এসব কারণে এবার আসন্ন সম্মেলনে ঢাকা মহানগর উত্তরের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা দলের ত্যাগী ও ক্লিন ইমেজের পরীক্ষিত নেতাদের মধ্য থেকে সাধারণ সম্পাদক বেছে নিতে চান। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা চান ঢাকার আদি ও স্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব বেছে নিতে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মহানগরের উত্তরের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এবার মহানগরের বর্তমান কমিটির অর্থ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগ জাতীয় কমিটির সদস্য মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ মো. ওয়াকিল উদ্দিন ও দফতর সম্পাদক এম. সাইফুল্লাহ্ সাইফুলের নাম এলাকার সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। তবে আলোচিত অনেকের বিরুদ্ধেই কোনো না কোনো অভিযোগ আছে, যা দলের হাই কমান্ডের নখদর্পণে রয়েছে। গুলশান, বনানী, বারিধারা, ক্যান্টনমেন্ট, উত্তরা, বাড্ডা, রামপুরা ও মহাখালীসহ মহানগর উত্তরে বিভিন্ন এলাকার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এবার সব দিক থেকে ক্লিন ইমেজ এবং পরীক্ষিত নেতা মুক্তিযোদ্ধা ওয়াকিল উদ্দিনকে মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দেখতে চান।
এবার প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যেভাবে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন নেতাদের দিয়ে দল গোছাতে চান, সে ক্ষেত্রে ঢাকা মহানগরী উত্তরের সবার আগে এক নম্বরে আসে ওয়াকিল উদ্দিনের নাম। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় পরিপুষ্ট ও দলের অভ্যন্তরে কোনো প্রকার অভিযোগ ছাড়া একমাত্র ওয়াকিল উদ্দিনই দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। যার সমতুল্য দ্বিতীয় অন্য কোনো নেতা উত্তরে আর কেউ নেই। তাছাড়া বিশিষ্ট গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও বিজিএমইর নেতা এসএম মান্নান কচি অবিভক্ত ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও উত্তরা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।
কিন্তু ইতোমধ্যেই ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের উত্তর-দক্ষিণের নেতাদের বেশ কিছু কর্মকাণ্ডে হাইকমান্ড নাখোশ বলেও জানিয়েছে একটি সূত্র। তাই অনেকেই মনে করছেন আসন্ন সম্মেলনে উভয় কমিটিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন সভাপতি পদের জন্য কাজ করছেন।
এছাড়া, দীর্ঘ দিনের সিনিয়র নেতা ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ও বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি, ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলার আবু আহমেদ মান্নাফীকে দেখা যেতে পারে। এছাড়া সভাপতি পদে আলোচনায় রয়েছে বিএমএর সভাপতি সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, অ্যাডভোকেট নজিবুল্লাহ হিরু ও জুবিলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সমরেন্দ্র নাথ রায়ের নাম। তাছাড়া দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক পদে বর্তমান কমিটির সহসভাপতি আওলাদ হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক মোর্শেদ কামাল, যুগ্ম সম্পাদক ডা. দিলীপ কুমার রায়, ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলার ওমর বিন আজিজ ও মিরাজ সহোসেনের নামও শোনা যাচ্ছে বেশ জোরেশোরে।
তবে সব কিছুই নির্ভর করে আওয়ামী লীগ প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সবুজ সংকেতের ওপর। যেহেতু রাজধানী ঢাকা মহানগর হচ্ছে রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র, তাই এখানকার কমিটিকে সব বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য, ক্লিন ইমেজের ও পরিচ্ছন্ন নেতাদের সমন্বয়েই হবে-এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এখন শুধুই অপেক্ষার পালা।