সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসেও জমে উঠেছে প্রাণের বই মেলা

- ১৬-ফেব্রুয়ারী-২০২০ ০৪:১১ অপরাহ্ন
:: আরিফুর রহমান ::
অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৫তম দিন ছিল গতকাল রোববার। লেখক-পাঠক-প্রকাশক আর নানা বয়সী মানুষের উপস্থিতিতে মাঝ পর্বে এসে চিরচেনা রূপ ধরেছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২০। সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস থাকলেও মেলায় ছিল বইপ্রেমীদের ভিড়। বই কেনায় ব্যস্ত সময় পার করছেন ক্রেতারা। এতে দারুন খুশি মেলার প্রকাশক, লেখক ও বিক্রেতারা।
ফাগুনের বিকেলে, মিষ্টি-রোদ গায়ে মেখে সবাই হাজির হন মেলাপ্রাঙ্গণে। বিকেলে মেলার দরজা খুলতেই বসন্তের উচ্ছলতায় সবাই হাজির হন মেলায়। বগুড়া থেকে বইমেলায় ঘুরতে যাওয়া ইলিয়াস হোসেন এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ঘুরে ঘুরে অনেকগুলো বই কিনবো বলে ভেবে রেখেছি। মেলায় এসে বইপ্রেমী এতো মানুষ দেখে দারুণ লাগছে’। এদিকে বেচাকেনা ভালো হওয়ায় খুশি প্রকাশক-লেখক। এ বিষয়ে সময় প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদ ভোরের পাতাকে বলেন, ‘ফাগুনের প্রথম দিন থেকেই তো মেলার রূপ বদলে গেল। এখন পাঠক আসছেন, আর যারা আসছেন প্রায় সবাই বই কিনছেন। অনেকেই নতুন বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। কেউবা বইয়ের তালিকা করে জমিয়ে রাখছেন আজ-কালকের মধ্যে কিনবেন’।
সার্বিক বিষয়ে মেলা পরিচালনা পরিষদের সদস্য সচিব জালাল আহমেদ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘মেলার মাঝামাঝি আছি আমরা। এখন এর যে সত্যিকার জমজমাট রূপ তা দেখা যাচ্ছে। এ ধারা শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলেই আমরা আশা করছি’।
বই নিয়ে স্টলে জার্মানির লরা কলিং : জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্দোলনে সাড়া জাগানো সুইডেনের কিশোরী কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ (১৬)। এ বিস্ময় বালিকার সাড়া জাগানো বই অনুবাদ করেছেন বাংলাদেশের সাংবাদিক আবু তাহির মুস্তাকিম। বইটি প্রকাশ করেছে মাতৃভাষা প্রকাশ। গ্রেটার সেই বই বিক্রি করতে স্টলে এসেছিলেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক ড. লরা কলিং। বইটির বাংলা অনুবাদ ‘বদলে দেওয়ার জন্য কেউই ছোট নয়’। স্টলে দাঁড়িয়ে বইটিতে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কাজে গ্রেটার সমর্থক জার্মানির নাগরিক ড. লরা কলিং।
মাতৃভাষার প্রকাশক নেসার উদ্দীন আয়ূব এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘জার্মানির নাগরিক, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক ড. লরা কলিং স্বেচ্ছায় বইমেলায় এসেছেন। তিনি গ্রেটার বইটির কথা শুনে মাতৃভাষা প্রকাশের স্টলে এসেছেন। গ্রেটা থুনবার্গের বিশ্ববিখ্যাত বইটিতে অটোগ্রাফ দিয়েছেন। ক্রেতাদের সঙ্গে ছবি তুলেছেন।’ বইমেলায় অংশগ্রহণের অনুভূতি জানাতে গিয়ে ড. লরা কলিং বলেন, ‘গ্রেটা থুনবার্গকে আমি সমর্থন করি। তার বইতে অটোগ্রাফ দিতে পেরে ভালো লাগছে। বাংলাদেশের বইমেলায় অংশ নিতে পেরে আমি আনন্দিত। মাতৃভাষা প্রকাশের প্রতি কৃতজ্ঞতা।’
নতুন বই : বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গতকাল রোববার মেলায় নতুন বই এসেছে ১৪৬টি।
মূলমঞ্চের আয়োজন : বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় পিয়াস মজিদ রচিত মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলা একাডেমি শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষক শাহিদা খাতুন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কবি শিহাব সরকার এবং গবেষক ড. ইসরাইল খান। লেখকের বক্তব্য প্রদান করেন পিয়াস মজিদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
আলোচকরা বলেন, ভাষাশহীদের স্মৃতি-বিজড়িত এই মাসে বাংলা একাডেমিতে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলা একাডেমি শীর্ষক বইয়ের যে আলোচনা তা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বইটির লেখক পিয়াস মজিদ গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করেছেন। বহু উৎস থেকে পুরানো বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা, নথিপত্র প্রভৃতি ঘেঁটে অনেকের দৃষ্টির আগোচরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইতিহাসের মূল্যবান অনেকগুলো তথ্য সংগ্রহ ও একত্রিত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বাংলা একাডেমিÑ বইয়ে মুদ্রিত শিরোনামের তিনটি শব্দ অবিচ্ছেদ্য।
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির জীবনে গৌরবোজ্জ্বল একটি অধ্যায়। এই অধ্যায়ের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু; আর বাংলা একাডেমি মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি ভূমি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার ভ্রƒণকেন্দ্র। ষাটের দশক থেকে স্বাধীনতা অব্যবহিত পরবর্তী সময় পর্যন্ত বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র ছিল বাংলা একাডেমি। সেদিনের বাংলা একাডেমি তার কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে মানুষের জাতীয়তাবাদী মানসের ধারা বিকশিত করতে পেরেছিল। একাডেমির সেই ইতিহাস এই বইয়ের মধ্য দিয়ে আরও উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে।
আলোচকরা আরও বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। তাই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সূতিকাগার বাংলা একাডেমির সঙ্গেও তার সম্পর্কটি অতীব নিবিড়। অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক, তথ্যসমৃদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলা একাডেমি গ্রন্থটিতে লেখক পিয়াস মজিদ মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে বাংলা একাডেমির ভূমিকা এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাংলা একাডেমির সম্পর্কটি একজন গবেষকের দৃষ্টিকোণ থেকে দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। যারা বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসেন তাদের কাছে এ গ্রন্থটি সমাদৃত হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। গ্রন্থের লেখক বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলা একাডেমির পারস্পরিক যোগসূত্র অন্বেষার প্রেরণা থেকেই এ গ্রন্থের সৃষ্টি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলা একাডেমি বিষয়ে এ গ্রন্থটি রচনা করতে পেরে আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করছি।
সভাপতির বক্তব্যে সেলিনা হোসেন বলেন, পিয়াস মজিদ রচিত মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলা একাডেমি গ্রন্থটি মূলত বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ সর্বোপরি মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর সাংস্কৃতিক চেতনাকে ধারণ করেই রচিত। সাংস্কৃতিক চেতনা দিয়েও যে সংগ্রাম করা যায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়। ভাষা আন্দোলনের পর থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে বাংলা একাডেমির দীর্ঘ অভিযাত্রার ইতিহাস ও অর্জন নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এ গ্রন্থ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আজ লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন মাসরুর আরেফিন, সোহেল হাসান গালিব, সৈয়দ জাহিদ হাসান এবং আলতাফ শাহনেওয়াজ।
কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন কবি মাসুদুজ্জামান, মাহবুব আজীজ, জাহানারা পারভীন এবং আশরাফ জুয়েল। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী শিরিন ইসলাম, আজিজুল বাসার এবং মনিরুল ইসলাম। গতকাল ছিল আবুল ফারাহ্ মো. তোয়াহার পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বিশ্বভুবন’, জিনিয়া জ্যোৎ¯œার পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ‘জিনিয়া নৃত্যকলা একাডেমী’ এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী’-এর পরিবেশনা। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন শ্যামা প্রসাদ মজুমদার (কী-বোর্ড)।
আজকের মেলা : আজ সোমবার। অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৬তম দিন। মেলা চলবে বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ রচিত ৭ই মার্চের ভাষণ কেন বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদ : বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন অধ্যাপক মোহাম্মদ সেলিম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ এবং ড. কুতুব আজাদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, আবৃত্তি এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।