‘জয় বাংলা’ জাতীয় স্লোগান: উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তে আমরা গর্বিত

- ১১-মার্চ-২০২০ ০৪:২৭ অপরাহ্ন
:: ড. কাজী এরতেজা হাসান ::
‘জয় বাংলা’ স্লোগান ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা। গত মঙ্গলবার হাইকোর্ট এই স্লোগানকে জাতীয় স্লোগানের মর্যাদায় সিক্ত করেছেন। এই রায়ের মাধ্যমে সারা দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। অবশ্য অনেক আগেই জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগানে ঘোষিত করা উচিত ছিল। স্বাধীনতার এতো বছর পরেও হলেও দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোয় হাইকোর্ট মহান একটি দায়িত্ব পালন করেছে।
‘জয় বাংলা’ আমাদের স্বাধীনতার বিশেষ একটি মূলমন্ত্র। জাতীয় ঐক্যের স্লোগান এটি। মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীর সেনানীরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু আমরা দেখেছি, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মুছে ফেলতে হেন কোনো কাজ নেই করা হয়নি। একদিকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর চিহ্ন মুছে ফেলার তোড়জোড় চালানো হয়, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপ্রবাহকে মুছে ফেলাসহ বিকৃত করার গভীর ষড়যন্ত্র চালানো হয়। যে ‘জয় বাংলা’ আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে সাহস জুগিয়েছে, শক্তি বাড়িয়েছে, বাঙালি জাতির প্রাণের এই স্লোগান উচ্চারণেও বাধা নিষেধ আরোপ করা হয়। আসলে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে বাংলাদেশের ক্ষমতায় বসে পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা। খুনি সেনাশাসক জিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশকে নব্যপাকিস্তান বানানোর যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং সে অনুযায়ী কাজ শুরু করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতাকারী এদেশিয় পাকিস্তানি দোসর জামায়াত-রাজাকার আলশামসকে প্রত্যক্ষভাবেই ক্ষমতায় বসানো হয়। কুখ্যাত রাজাকারদের মন্ত্রী বানায় জাতির জনকের অন্যতম খুনি জিয়া। এভাবে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের দিকে টেনে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলে। জিয়াপত্নী বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় বসে জিয়ার পথই অনুসরণ করেন। তিনি কুখ্যাত পাকিস্তানি সেনা অফিসার জানজুয়ার মৃত্যুতে শোকজ্ঞাপন পর্যন্ত করেন। এই জানজুয়া স্বাধীনতার সময়ে মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারী ব্যক্তিদের মধ্যে বিশেষ একজন পাকিস্তানি হানাদার।
তাই এদের কাছ থেকে স্বাধীনতা সমর্থক কোন স্লোগান বা চর্চা আশা করা বোকামি। আর ঘটনা তেমনি ঘটেছে। তারা জয়বাংলাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে জনগণের মন থেকে তা মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। সেখানে তারা পাকিস্তানি কায়দায় জিন্দাবাদ প্রবর্তন করেছে। আবার তারা পাকিস্তানিদের মনের মানুষ হতে অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়েছে। এখনো তাদের বক্তব্য বক্তৃতা তারই সাক্ষ্য দেয়। তাহলে কিভাবে এদের কাছ থেকে আশা করা যায়, ‘জয় বাংলা’ কে জাতীয় স্লোগানের মর্যাদা দান? কিন্তু জাতির জনকের সুযোগ্যকন্যা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে স্বাধীনতার চেতনাকে ফিরিয়ে এনেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের হৃতগৌরব ফিরিয়ে এনেছেন। মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাস বিকৃত করে যে মনগড়া ইতিহাস তৈরি করেছিল খুনি জিয়াউর রহমান এবং তার পত্নী বেগম জিয়া, মুক্তিযুদ্ধের সেই বিকৃত ইতিহাস বাদ দিয়ে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জাতির সামনে তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক এবং হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে তিমিরে রাখার যে হীনচেষ্টা চালিয়েছিল জিয়া-খালেদা, তা উৎপাটন করে নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরা হয়। তুলে ধরা হয় জয় বাংলা স্লোগানের প্রেক্ষাপট। মুক্তিযুদ্ধে এই স্লোগান কতটা মন্ত্রের মতো কাজ করেছে তা নতুনভাবে আলোচনায় আসে। এই সময়ের ছেলে-মেয়েরা বুঝতে পারেন, জয় বাংলা স্লোগান কতটা শক্তি ধারণ করে আছে। জয় বাংলা স্লোগানকে জাতীয় স্লোগানের মর্যাদা দিয়ে গত মঙ্গলবার হাইকোর্ট যুগান্তকারী একটি রায় দিয়েছেন। এই রায় হলো গোটা দেশের মানুষের কাঙ্ক্ষিত রায়।
এ ব্যাপারে গণমাধ্যম খবরে বলা হয় :‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী তিন মাসের মধ্যে এ রায় কার্যকর করতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি তাদের রায় বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতিবেদনও একই সময়ের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গণমাধ্যমগুলো আরো বলেছে, ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা চেয়ে ২০১৭ সালে হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। পরে ওই বছরের ৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল জারি করেন। গতকাল ওই রুল নিষ্পত্তি রায় দেন হাইকোর্ট।
রায়ে বলা হয়, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বস্তরের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান বলতে ও দিতে হবে। রায় ঘোষণার সময় আদালত বলেন, আমরা ঘোষণা করছি যে, ‘জয় বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হবে। সব জাতীয় দিবস এবং উপযুক্ত ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদাধিকারীগণ এবং রাষ্ট্রীয় সব কর্মকর্তা সরকারি অনুষ্ঠানের বক্তব্য শেষে যেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করেন, সে জন্য সংশ্লিষ্ট বিবাদীরা যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। এ ছাড়া সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অ্যাস্মেব্লি সমাপ্তির পর ছাত্র-শিক্ষকরা যেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করেন, সে জন্যও বিবাদীরা যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।’
আদালত আরও বলেন, ‘জাতীয় স্লোগান হিসেবে ‘জয় বাংলা’কে ব্যবহার করতে দ্বিধা কোথায়? আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে এ স্লোগান ওতপ্রোতভাবে জড়িত।’ রায় ঘোষণার পর আদালত থেকে বেরিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন রিটকারীসহ উপস্থিত আইনজীবীরা। রায়ে সন্তোষও প্রকাশ করেন তারা। স্বাধীনতার এতবছর পরেও এই যে অর্জন একে পাথেয় করে বাঙালি জাতিকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। জাতির জনক যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, তার সেই স্বপ্নকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। বিশ^নেতা-রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে বিশে^র বুকে অনেক উচ্চতায় তুলে ধরেছেন। অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি দেশকে আজ এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন। কিন্তু কতিপয় ব্যক্তির কারণে দেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে। আওয়ামী লীগকে ভাঙিয়ে অর্থবিত্ত অর্জনের হীন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এইসব ব্যক্তির মুখে অতিমাত্রায় বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার নাম উচ্চারিত হতে দেখা যাচ্ছে। এরা কোনোভাবেই যেন দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে না পারে তার প্রতি বিশেষ নজর রাখতে হবে। প্রশাসনে একশ্রেণির ব্যক্তির সীমাহীন দুর্নীতির কারণে দেশের অগ্রগতি ব্যহত হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী যে যুদ্ধঘোষণা করেছেন তা যেন থেমে না যায়, তার প্রতিও গভীর নজর রাখা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। যে ‘জয় বাংলা’ ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ প্রেরণাদায়ক স্লোগান- তাকে জাতীয় স্লোগানের মর্যাদায় অভিশিক্ত করাটা তখন আরো স্বার্থক হবে যখন দেশ থেকে দুর্নীতিবাজ, জঙ্গি ও মাদক নিমূর্ল করা সম্ভব হবে। যারা ক্ষমতার ব্যবহার একান্তই নিজেদের স্বার্থে করছে, তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই জয় বাংলা স্লোগানের অন্তর্নিহিত সারাৎসার দ্বারা জাতি আরো বেশি উপকৃত হবে।