ফুঁসছে ধানখালী-চম্পাপুর

- ১৫-Oct-২০১৮ ০৬:০০ অপরাহ্ন
* ধানখালী-চম্পাপুরের সকল জমিই তিন ফসলি-
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারন কর্মকর্তা
* নড়েচড়ে বসেছে জেলা প্রশাসক কার্যালয়।
:: আবেগ রহমান, পটুয়াখালী থেকে ফিরে ::
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ধানখালী ও চম্পাপুর ইউনিয়নের তিন-ফসলি জমি সরেজমিন তদন্ত করে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, ‘ধানখালী ও চম্পাপুর ইউনিয়নের পাঁচজুনিয়া, ছৈলাবুনিয়া ও দেবপুর গ্রামের অধিকাংশই তিন-ফসলি ও আড়াই-ফসলি জমি।’ এ সময় তাকে আড়াই-ফসলি বলতে কী বোঝা যায় প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এখানকার কৃষকরা মাঝেমধ্যে কিছু কিছু জমিতে তিন-ফসলি করে, মাঝেমধ্যে করে না।’ যদিও তার এই উত্তর থেকেই এখানকার জমি যে তিন-ফসলি তা স্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, ‘দুই-ফসলির ওপরে হলেই আর অধিগ্রহণ করা যায় না।’
আবার কিছু মানুষ এখানে টাকার লোভে দালালদের খপ্পরে পড়ে তিন-ফসলি জমিতে তড়িঘড়ি টিনের ঘর তুলেছেন বলেও তিনি স্বীকার করেছেন।
গত শুক্রবার দুপুরে উপজেলা কৃষি বিভাগের অন্যান্য কর্মকর্তাসহ তিনি ওই এলাকা পরিদর্শন করেন। তিন-ফসলি জমি ও সুপেয় পানির খাল ভরাট করে ধানখালী-চম্পাপুরে বারবার ভূমি অধিগ্রহণ ও একাধিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদে ইতোমধ্যে এলাকাবাসী বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। এই এলাকার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব বয়সী মানুষ কাফনের কাপড় পরে চলাফেরা করছেন। এলাকাবাসীর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, এখানে রোহিঙ্গা গ্রাম সৃষ্টি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এখানে বিস্তৃত এলাকা অধিগ্রহণ করা হলেও এলাকাবাসী জমির মূল্য পাননি। উপরন্তু তারা ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছেন। এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়িবাঁধে রোহিঙ্গাদেও মতো মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
এ প্রসঙ্গে চম্পাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রিন্টু তালুকদার একবাক্যে অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, ‘এখানে ভূমি অধিগ্রহণ নিয়মতান্ত্রিকভাবে হয়নি। যা হয়েছে তাতে ভূমি মালিকরা বঞ্চিত হয়েছেন।’ ইতিপূর্বে এসব সুনির্দিষ্ট অনিয়মের কারণেই নতুন করে ধানখালী ইউনিয়নের পাঁচজুনিয়া, ছৈলাবুনিয়া ও পার্শ্ববর্তী চম্পাপুর ইউনিয়নাধীন দেবপুর গ্রামের প্রায় ১ হাজার একর ভূমি পুনঃঅধিগ্রহণকে জীবন দিয়ে হলেও ঠেকাবেন বলে সর্বস্তরের এলাকাবাসী শপথ নিয়েছেন। কারণ এরপর ধানখালী-চম্পাপুরে আর চাষযোগ্য কোনো জমিই থাকবে না।
নিত্যদিন এই দুই ইউনিয়ন এখন নানা আন্দোলন কর্মসূচিতে উত্তাল। বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার রাম চন্দ্র দাশ এবং পটুয়াখালীর সাবেক জেলা প্রশাসক ড. মো. মাছুমুর রহমানসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে স্মারকলিপির মাধ্যমে তদন্তসাপেক্ষে বিষয়টি অতিসম্প্রতি নজরে আনতে সক্ষম হন ধানখালী-চম্পাপুরের জনগণ। এরই প্রেক্ষিতে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে প্রকৃত ঘটনা জানতে চেয়ে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপির বিষয়ে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে পটুয়াখালীতে নতুন জেলা প্রশাসক মতিউল ইসলাম চৌধুরী যোগদান করায় এলাকাবাসী আশায় বুক বেঁধেছেন। কেননা ধানখালী- চম্পাপুরের এই ভূমি অধিগ্রহণ কলংকের জন্য সাবেক জেলা প্রশাসক ড. মো. মাছুমুর রহমান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তানভীর আহমেদসহ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তাদের বেশি দায়ী করছেন এলাকাবাসী।
এলাকাবাসীর দাবি, একটি স্থানে ৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন নজিরবিহীন। একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দেড়-দুই কিলোমিটারের মধ্যেই নিয়মবহির্ভূতভাবে আর একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। এগুলো ৪০০ বছরেরও পুরনো গ্রাম। এসব এলাকার জমির দলিলও ১০০ বছরের পুরনো। তার ওপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ উপেক্ষা করে সম্পূর্ণরূপে তিন-ফসলি জমি পুনঃঅধিগ্রহণের জোর চেষ্টা চলছে। সাবেক জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তারা এতদিন সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করেছেন।
জানা গেছে, শুধু নিজেদের পকেট ভারী করতে স্থানীয় কিছু দালালচক্রের সঙ্গে প্রশাসনও মিলে গিয়েছিল। সেজন্যই পাশে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মতো অনাবাদি জমি থাকা সত্ত্বেও প্রায় ৪০০ বছরেরও পুরনো এসব গ্রামে মানুষের ভিটেমাটি, স্কুল-কলেজ, কবরস্থান, মসজিদ-মন্দিরসহ তিস-ফসলি জমিই অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। আর সরকারের উচ্চপর্যায়ে বোঝানো হয়েছে এগুলো অনাবাদি জমি।
এদিকে দুই ইউনিয়নের মানুষ পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি রক্ষায় বর্তমানে সোচ্চার ও প্রতিবাদমুখর। কোনোমতেই তিন-ফসলি জমি অধিগ্রহণ করে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে দেবেন না এলাকাবাসী। তিন-ফসলি জমি, বসতভিটা ও সুপেয় পানির খাল রক্ষায় এলাকাবাসীর স্লোগান ‘জীবন দেবো-জমি দেবে না’, ‘লাশ হবো, জমি দেবো না’ ইত্যাদি। এমনকি কাফনের কাপড় পরে মাটিতে লুটিয়ে পড়েও বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে আসছেন এলাকাবাসী।
ধানখালী ও চম্পাপুর ইউনিয়নের প্রবীণ আতাউর রহমান, মো. মিজানুর রহমান, মো. খলিলুর রহমান, আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, গত শুক্রবার দুপুরে স্থানীয়দের উপস্থিতিতে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের বিগত বছরের উৎপাদিত ফসল সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে দুই ইউনিয়নের তিন-ফসলি জমির চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এলাকাবাসী জানান, ধানখালী ও চম্পাপুর ইউনিয়নের তিন-ফসলি জমি, ঘনবসতি, সুপেয় পানির খালসহ পূর্বপুরুষদের কবর রক্ষায় বিভিন্ন আন্দোলন-কর্মসূচি পালন করেও এতদিন প্রসাশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়নি। বিষয়টি কোনোভাবে আমলেই নেয়নি প্রশাসন। দুই ইউনিয়নের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন সভা-সমাবেশ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি শেষে গত ৫ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মানববন্ধন শেষে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। এরপর ১১ সেপ্টেম্বর এলাকাবাসী বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার বরাবরে একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন। পরবর্তীতে বিভাগীয় কমিশনারের আশ্বাসে পথ চেয়ে আছেন ধানখালী ও চম্পাপুর দুই ইউনিয়নের হাজার হাজার ভুক্তভোগী।
ওই স্মারকলিপিতে দুই ইউনিয়নের সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষা করে তিন-ফসলি জমি অধিগ্রহণ, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সুপেয় পানির খাল ভরাট, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বারো কিলোমিটারের মধ্যে পুনরায় ভূমি অধিগ্রহণ না করার বিধি লঙ্ঘিত হয়েছে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী তিন-ফসলি জমি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য অধিগ্রহণ করা যাবে না। তারপরও ধানখালী ও চম্পাপুর ইউনিয়নে তিন-ফসলি জমিতে একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া চলছে।
ধানখালী ইউনিয়নের পাঁচজুনিয়া, ছৈলাবুনিয়া, নিশানবাড়িয়া ও পার্শ¦বর্তী চম্পাপুর ইউনিয়নের দেবপুর গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দারা জানান, একটি সংস্থা পাঁচজুনিয়া গ্রামের ২নং ওয়ার্ডে তিনশ একর, ছৈলাবুনিয়া গ্রামে চারশ একর, নিশানবাড়িয়া গ্রামে ২৯ একর ও চম্পাপুর ইউনিয়নাধীন দেবপুর গ্রামে ২৭০ একরসহ মোট ১ হাজার একর ভূমির সীমানা নির্ধারণ করে অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সীমানা ম্যাপ ও কাগজপত্র দাখিল করেছে। সংস্থাটি স্থানীয় জনসাধারণের বেঁচে থাকার চিন্তা না করে, তাদের মতামত যাচাই না করে জীবিকার একমাত্র উৎস তিন-ফসলি ভূমি অধিগ্রহণ করতে চাইছে।
পাঁচজুনিয়া গ্রামটির মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট দুটি বড় খাল। এই খাল দুটি বন্যা ও অতিবৃষ্টির পানি নিষ্কাশন করে আবার প্রয়োজনে মিষ্টি পানির জোগান দিয়ে গ্রামটিকে শস্যভা-ারে পরিণত করেছে। একটি খালের তীর ঘেঁষে সারি সারি সাজানো বাড়ি এবং পাকা রাস্তা রয়েছে। রাস্তাটি কলাপাড়া উপজেলা, আমতলী উপজেলা এবং পটুয়াখালী জেলাসহ বাংলাদেশের সব জেলার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে। গ্রামটিতে ৩টি সাইক্লোন শেল্টার কাম প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ মোট ৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১টি এবতেদায়ি ও দাখিল মহিলা মাদরাসা, ১টি কওমি মাদরাসা ও লিল্লাহ্্ বোর্ডিং, ১টি ডিগ্রি কলেজ, ১টি টেকনিক্যাল কলেজ, ২টি নূরানী মাদরাসা, ১টি সাইক্লোন শেল্টার কাম সরকারি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ১টি সরকারি পরিবার পরিকল্পনা অফিস, ১টি ভূমি অফিস, ১টি ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, ১টি সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিক, ১টি সরকারি কৃষি গুদামঘর, ২টি ৬০০ ফুট লম্বা সরকারি পাকা কৃষি ড্রেন, ৩টি আইপিএম ক্লাব যাতে সরকার ২ মাসের কৃষি প্রশিক্ষণ, ট্রাক্টর, পাওয়ার থ্রেচার, সেচ পাম্প, কয়েক রকমের স্প্রে মেশিন এবং তথ্য-প্রযুক্তির জন্য ল্যাপটপ, প্রিন্টার, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরসহ (প্রয়োজনীয় উপকরণ বিনামূল্যে প্রদান করেছেন), এর মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠ ক্লাব বিভাগ (এখানে তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে খামারবাড়ী থেকে সরাসরি কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হয়), ব্রিটিশ আমলের ২টি বিখ্যাত পুরনো বাজারসহ মোট ৩টি বাজার, ১০টি এনজিও অফিস, ১টি এআইসিসি কেন্দ্র, ১৫টি বড় মৎস্য খামারসহ ১৫০টি ছোট-বড় পুকুর, প্রায় ২০টি পোল্ট্রি ফার্ম, ১টি খানকা, ১টি রহমত বাংলা, ১টি শেফা বাংলা (যেখানে গ্রামের মানুষদেরকে ফ্রি চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়), ১৫টি মসজিদ ও হযরত শাহ্্ সুফি কফিলউদ্দিন আহমেদ (রহ:)-এর মাজার শরিফ অবস্থিত। মসজিদগুলোর একটি হচ্ছে মোগল নকশায় নির্মিত অতিসুরম্য তিন গম্বুজ পীরানে পীর গালিপুরী হযরত শাহ্্ সুফি আফাজ উদ্দিন শাহ্্ (রহ:) জামে মসজিদ। পীরসাহেব হযরত কফিলউদ্দিন আহমেদ (রহ:) নিজে তার যৌবনে মসজিদটি নির্মাণ করেন।
পরবর্তীকালে পীর সাহেবের স্ত্রী মরহুম হাসিনা বানু ও তার কন্যা মাজী নাহার আল বোখারী মসজিদটিকে সংস্কার ও আধুনিকায়ন করেন। পাঁচজুনিয়া ও দেবপুর মৌজার বেশ কয়েক একর জমি মসজিদটির নামে দান করা হয়েছে। এখানে বাংলাদেশে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কোয়ান্টাম মেথডের জনক, গুরুজি শহীদ আল বোখারীর ১টি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন অফিস ও ১টি মেডিটেশন সেল রয়েছে। প্রতিদিন এখানে বহু লোক ইবাদত ও দর্শনের জন্যে আসেন এবং আত্মশুদ্ধি ও আত্মউন্নয়নের জন্যে কোয়ান্টাম সেলে মেডিটেশন করেন।
এছাড়া অতিগুরুত্বপূর্ণ ১টি চারশ বছর পুরনো আমলের দিঘি আছে যা আধ্যাত্মিক পুরুষ হযরত কফিল উদ্দিন আহমেদ (রহ:)-এর পূর্বপুরুষেরা পবিত্রতা অর্জন ও সুপেয় মিষ্টি পানির জন্যে খনন করেছিলেন। জমিদার কন্যা, পীরসাহেবের মাতা ছিলেন শিক্ষিত ও পরম শ্রদ্ধেয়। এলাকার লোকজন তাকে আম্মাজান বলে ডাকেন। তাই পীরসাহেব মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন কওে দিঘিটির নামকরণ করেন ‘আম্মাজান দিঘি’। সর্বশেষ ২০০৯ সালে পীরসাহেবের কন্যা ও গুরুজি শহীদ আল বোখারীর পরমা স্ত্রী মাজী নাহার আল বোখারী দিঘিটিকে সংস্কার করে সৌন্দর্যবর্ধন করেন। দিঘিটি আমাদের দেশের পুরনো ঐতিহ্য এবং গর্ব। দিঘিটিসহ সব স্থাপনা ও অফিস এবং তিন-ফসলি সরস জমি টিকিয়ে রাখার জন্য জোর দাবি জানান এলাকাবাসী।
ধানখালীর দেবপুর গ্রামটি প্রাকৃতিক পরিবেশে ভরপুর অতিসুন্দর ছোট্ট একটি ঐতিহ্যপূর্ণ গ্রাম। এ গ্রামের সঙ্গে প্রায় ১ হাজার বছর আগের স্মৃতিজড়িত। লোকশ্রুতি আছে, ষোল দরুন এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সনাতন ধর্মের পূজারি এই গ্রামে বাস করত। তৎকালীন সময় পূজা-অর্চনার সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ায় গ্রামটির নামকরণ করা হয় দেবপুর। এখানে রাবনাবাদ নদীর তীর ঘেঁষে সনাতনধর্মীদের সারি সারি বাড়ি এবং বেশ কয়েকটি বিখ্যাত মন্দির ও উপাসনালয় ছিল, যেগুলো আগুনমুখোর তা-বে নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে। পরবর্তীতে গ্রামটি অধিক সুফসলা হওয়ায় ফরিদপুর থেকে গ্রামের পূর্বপুরুষরা এখানে মাইগ্রেট করে দেবপুর খালটির তীরে বসতি স্থাপন করেন এবং বর্তমানে তাদের উত্তরসূরিরাই এ গ্রামে বসবাস করছেন। গ্রামের পূর্বপাশে রয়েছে রাবনাবাদ নদী এবং পশ্চিম পাশে রয়েছে ফসলের মিষ্টি পানির উৎস ‘দেবপুর খাল’। খালটি দেবপুর গ্রাম থেকে ধানখালী ইউনিয়নাধীন পাঁচজুনিয়া গ্রামকে বিভাজিত করেছে। বলা যায়, রাবনাবাদ নদী ও দেবপুর খাল দুটোই এই গ্রামের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। আউশ ও আমন মৌসুমে মাঝেমধ্যে নদী থেকে পলিযুক্ত পানি গ্রামের মাঠের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এই খাল দিয়ে নিষ্কাশন হয়। এতে মাঠের ভূমি হয় উর্বর, সরস ও সুফসলা। আবার বোরো ও রবি মৌসুমে খালের মিষ্টি পানি ব্যবহার করে গ্রামের কৃষকরা লাখ লাখ টাকার বোরো ধান, তরমুজ, বাদাম, মরিচ, বিভিন্ন প্রকার ডাল, তেলবীজ ও নানারকমের শাক-সবজি উৎপাদন করেন। এই গ্রামের উৎপাদিত ফসল পটুয়াখালী জেলাসহ অনেক জেলার খাদ্য চাহিদা পূরণ করে আসছে। এছাড়া দেবপুর গ্রামটিতে রয়েছে প্রায় ৬শ কৃষি পরিবার, ৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৭টি মসজিদ, ১০০টির অধিক মৎস্য খামার ও পুকুর, বেশ কয়েকটি পোল্ট্রি খামার, ২টি আইপিএম ক্লাব। রাবনাবাদ নদীতে বড় আকারের বেড়িবাঁধ থাকায় গ্রামের সব কৃষক গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া পালন করে বেশ লাভবান হচ্ছেন। এমন ঐতিহ্যবাহী তিন-ফসলা গ্রামটিকে কোম্পানির অধিগ্রহণের হাত থেকে রক্ষার আন্দোলন ফুঁসে উঠেছে।
ধানখালীর ছৈলাবুনিয়া ও নিশানবাড়িয়া গ্রাম দুটিও বেশ সুন্দর এবং ঐতিহ্যপূর্ণ। আশুগঞ্জ কোম্পানি পাঁচজুনিয়া ও দেবপুর গ্রামের উত্তর দিকের অর্ধেক অংশ অধিগ্রহণের জন্য ৩ ও ৬ ধারার নোটিশ করেছে। যেটুকু বাকি আছে তাও যদি অন্য একটি সংস্থা অধিগ্রহণ করে, তাহলে ধানখালী-চম্পাপুরের শেষ সম্বলটুকু শেষ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের বুক থেকে অনন্য দুটি গ্রাম মুছে যাবে।
ইতিপূর্বে ধানখালী থেকে নর্থ-ওয়েস্ট-১৩২০ মেগাওয়াট, আরপিসিএল-১৩২০ মেগাওয়াট, আশুগঞ্জ-১৩২০ মেগাওয়াট, সিমেন্স-৩৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রায় ৩ হাজার একর ভূমি অধিগ্রহণ করেছে। এখন যদি অন্য একটি সংস্থা আরো ১ হাজার একর ভূমি অধিগ্রহণ করে তাহলে ধানখালীতে তিন-ফসলি জমির আর কোনো চিহ্নই থাকবে না। তাছাড়া একটি ইউনিয়ন থেকে পাঁচটি পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য সব তিন-ফসলি জমি অধিগ্রহণ করা একেবারেই অবাস্তব।
যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে একনেকের বৈঠকে ধানী জমিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র না করার নির্দেশ দিয়েছেন। পাঁচজুনিয়া, ধানখালীর ছৈলাবুনিয়া, দেবপুর ও নিশানবাড়িয়া গ্রামের সব জমি তিন-ফসলি উর্বর, সরস। গ্রামগুলোর ৮০ ভাগ লোকই কৃষিজীবী। এখানে আউশ, আমন, বোরোসহ কোটি কোটি টাকার তরমুজ, বিভিন্ন প্রকার ডাল, তেলবীজ, মরিচ, বাদাম, পেঁয়াজ, রসুন ও বিভিন্ন প্রকার শাক-সবজি উৎপাদিত হয়। গ্রামগুলোর মাটি দো-আঁশ ও পলির মিশ্রণ হওয়ায় কৃষকরা বারো মাসই কোনো না কোনো ফসল ঘরে তোলেন। কৃষি কাজই গ্রামের জনসাধারণের জীবিকার একমাত্র উৎস, তাছাড়া জীবিকার জন্য অন্য কোনো কাজ তাদের জানা নেই। তাই পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া ভিটেমাটি, কবরস্থান এবং জীবিকার একমাত্র উৎস তিন-ফসলি এসব জমি অধিগ্রহণ থেকে রক্ষা করতে এলাকাবাসী এখন জীবন দিতেও প্রস্তুত।
জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি ২০০১ এবং কৃষি জমি সুরক্ষা আইন ২০১৫-এ বলা হয়েছে যে, দুই বা তিন-ফসলি জমিতে সরকারি/বেসরকারি কোনো অবস্থাতেই ভূমি অধিগ্রহণ করা যাবে না। একই মৌজা থেকে দুবার জমি অধিগ্রহণ করা যাবে না। এমনকি তিন-ফসলি জমিতে বসতভিটা তৈরি করতে হলেও সরকারের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে।
শিল্পনীতি অনুযায়ী জনবসতিপূর্ণ এলাকায় কোনো শিল্প, কলকারখানা, ইটের ভাটা নির্মাণ করা যাবে না। জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি না হয়, এমন দূরত্ব বজায় রেখে জনশূন্য এলাকায় শিল্প-কারখানা স্থাপন করতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিবেশ আইন অনুযায়ী দুটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যবর্তী দূরত্ব কমপক্ষে ১২ কিলোমিটারের অধিক হতে হবে। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট সব ধরনের নদী, খাল ও সুপেয় পানির উৎস সংরক্ষণ করতে হবে। সব নিয়মনীতিই ধানখালী-চম্পাপুরে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
ধানখালী ও চম্পাপুরে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে পরিচালিত কর্মকা- জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি ২০০১ এবং কৃষি জমি সুরক্ষা আইন ২০১৫, আন্তর্জাতিক পরিবেশ আইন এবং প্রধানমন্ত্রীর তিন-ফসলি জমি অধিগ্রহণ না করার নির্দেশনা (১০ নভেম্বর ২০১৬, দৈনিক যুগান্তর) সব বিধিবিধান ও নির্দেশনা উপেক্ষিত হচ্ছে।
এসব বিষয় বিবেচনাপূর্বক পাঁচজুনিয়া, ধানখালী (ছৈলাবুনিয়া) ও দেবপুর গ্রামবাসীর বেঁচে থাকার শেষ সম্বল এই তিন-ফসলি জমি রক্ষা করে সংস্থাটিকে অন্য কোনো এলাকার অনাবাদি বা পতিত জমিতে স্থানান্তর করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করে স্মারকলিপি প্রদান করা হলেও কর্তৃপক্ষকে এখনও কার্যকরী কোনেঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।
কলাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আবদুল মান্নান জানান, ‘ধানখালী ও চম্পাপুরে তিন-ফসলি জমির বিষয়ে যাচাইপূর্বক প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ আছে। এখন পর্যন্ত আমরা যতদূর জানতে পেরেছি, ধানখালী ও চম্পাপুরের সবই তিন-ফসলি জমি। তারপরও আমরা সার্বিকভাবে ফসলি জমির ধরন যাচাই করে অচিরেই প্রতিবেদন দাখিল করব।’