যে নেপথ্য কারণে পাহাড়ে ৬ খুন

- ১৮-Aug-২০১৮ ০৬:০০ অপরাহ্ন
ভোরের পাতা ডেস্ক
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত পাহাড়ে সংস্কারপন্থি জনসংহতির সঙ্গে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) দৃশ্যত কোনো বিরোধ ছিল না। এমনকি নির্বাচনে দুই দলের দুই প্রার্থী মাঠে থাকলেও কোনো সংঘাত হয়নি। সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও এ দুটি আঞ্চলিক দল ভাগাভাগির ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করেছিল। ইউপিডিএফ থেকে বহিস্কৃত তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাকে দল গঠনের সুযোগ দেওয়ার সন্দেহ থেকে প্রথমে দুই দলের সশস্ত্র শাখার মধ্যে পাল্টাপাল্টি আক্রমণ শুরু হয়। পরে তা দল দুটির রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় সূত্র জানায়, গত বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝিতে প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের সশস্ত্র শাখার প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে আরেকটি দলের আত্মপ্রকাশ ঘটলেই অস্থির হয়ে ওঠে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির দুটি উপজেলা।
ইউপিডিএফ সূত্র জানায়, গত বছর নভেম্বর থেকে চলতি আগস্ট পর্যন্ত মূল সংগঠন এবং সহযোগী সংগঠনের ২০ নেতাকর্মী ও সমর্থক খুন হয়েছেন। গত বছরের ডিসেম্বরেই রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় ইউপিডিএফের কর্মী সাবেক ইউপি সদস্য অনাদিরঞ্জন চাকমা ও সমর্থক অনিল বিকাশ চাকমা খুন হন। এ হত্যাকাণ্ডের রেশ না কাটতেই জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে নিজ বাড়ির সামনে থেকে তুলে নিয়ে মিঠুন চাকমাকে খুন করা হয়। ইউপিডিএফভুক্ত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাবেক এ কেন্দ্রীয় সভাপতি ইউপিডিএফের অন্যতম শক্তিশালী জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। এ ঘটনার এক মাস বিরতিতে ১৭ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি জেলা সদরের রাঙাপানি ছড়ায় দীলিপ চাকমা খুন হন। এ ঘটনার তিন দিন পর জেলার দীঘিনালা উপজেলার জামতলীতে গুলি করে সাইন চাকমা সুপারা নামে এক ইউপিডিএফ কর্মীকে হত্যা করা হয়। মার্চে খাগড়াছড়ির সীমান্তবর্তী উপজেলা বাঘাইছড়িতে নতুন মনি চাকমা নামের আরও এক কর্মীকে হত্যা করা হয়। এপ্রিলে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের কমলছড়িতে সমাজকর্মী সূর্য বিকাশ চাকমা খুন হন। নিজেদের নেতা বা কর্মী না হওয়া সত্ত্বেও ইউপিডিএফ তার মৃত্যুর প্রতিবাদে খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল করে। একই সপ্তাহে খাগড়াছড়ির পানছড়িতে খুন হন ইউপিডিএফ সংগঠক নতুন কুমার ত্রিপুরা। ২২ মে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় উজ্জ্বল কান্তি চাকমা ওরফে মার্শাল নামে আরও এক কর্মী প্রতিপক্ষের হাতে প্রাণ হারান। এ ছাড়া খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালায় নিজ বাড়িতে ফেরার পথে জেরান চাকমা নামের সাবেক এক পিসিপি কর্মীকে দীঘিনালা বাসস্টেশন থেকে প্রকাশ্যে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। সেই থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন। ২৮ মে রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে সঞ্জীব চাকমা, অতল চাকমা ও স্মৃতি চাকমাকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। এছাড়া একাধিক ঘটনায় নানিয়ারচর, বাঘাইছড়ি ও পানছড়িতে কিরণ চাকমা, জনি তঞ্চঙ্গ্যা ও সুনীল বিকাশ চাকমা নামে তিন ইউপিডিএফ কর্মী খুন হন। গত সপ্তাহে দীঘিনালা উপজেলা সদরে দুর্বৃত্তদের হাতে প্রাণ হারান মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু নামের ইউপিডিএফের সাবেক এক কালেক্টর। এসব হত্যাকাণ্ডে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জেএসএস (এমএন লারমা) ও গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফকে দায়ী করেছে প্রসীত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ। তখন অভিযোগ অস্বীকার করে জেএসএস (এমএন লারমা) কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা জানিয়েছিলেন, ইউপিডিএফের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণেই এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। অপরদিকে একই সময়ে খাগড়াছড়িসহ নানিয়ারচর ও বাঘাইছড়িতে পাল্টা হামলায় জেএসএসের (এমএন লারমা) শীর্ষ ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) দলীয় প্রধানসহ ১১ জন খুন হন।
৩ মে রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেএসএস (এমএন লারমা) কেন্দ্রীয় সহসভাপতি অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমা খুন হন। শক্তিমান চাকমা ছিলেন দলটির অন্যতম প্রধান নেতা। এ ঘটনার দুই দিনের মাথায় শক্তিমান চাকমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে গিয়ে পথে সশস্ত্র হামলায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাসহ ৬ জন। এর মধ্যে বর্মা ছাড়া দুইজন জনসংহতি সমিতির ছাত্র ও যুব কর্মী।
গত জুন ও জুলাইয়ে সুরেশ বিকাশ চাকমা, জঙ্গলী চাকমা, পঞ্চানন চাকমা, বিজয় কুমার চাকমা, শান্তিরঞ্জন চাকমা নামে এক জেএসএস কর্মীকে গুলি ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের জন্য ইউপিডিএফকে (প্রসীত) দায়ী করেছিল জেএসএস (এমএন লারমা)। সর্বশেষ ২৬ জুলাই রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে খুন হন বনকুসুম চাকমা। তিনি জেএসএস (এমএন লারমা) অংশের কর্মী বলে জানা যায়।
জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) অংশের রাজনৈতিক শাখা থেকে জানানো হয়, চলতি বছরের এপ্রিল থেকেই ইউপিডিএফের সঙ্গে তাদের সশস্ত্র সংঘাত শুরু হয়েছে। তখন থেকে এ পর্যন্ত দলটির ১২ নেতাকর্মী প্রাণ হারানোর পাশাপাশি আহত হয়েছেন পাঁচ নেতাকর্মী।
খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগ নেতা নির্মলেন্দু চৌধুরী মনে করেন, অবৈধ অস্ত্রের কারণেই একের পর এক প্রাণহানি ঘটছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে। তিনি আঞ্চলিক দলগুলোকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে হত্যা-সংঘাত ও চাঁদাবাজি বন্ধ করে সরকারের চলমান উন্নয়নে সম্পৃক্ত হওয়ারও আহ্বান জানান।
সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র) খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি ও নারীনেত্রী নমিতা চাকমা গত ছয় মাসে খুনোখুনি বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, জেলা ও উপজেলা শহরে দিনদুপুরে জনপ্রতিনিধি-ছাত্র-যুবকদের প্রাণহানির ঘটনায় শঙ্কিত। নিরীহ মানুষও রক্ষা পাচ্ছেন না। পাহাড়ে জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের পক্ষেই সম্ভব। আর যদি এটিকে পাহাড়িদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়, তাহলে তা কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, পাহাড়ে প্রতিনিয়ত হত্যা বেড়েই চলেছে। একের পর এক সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে না বলেই সন্ত্রাসের প্রবণতা বাড়ছে। প্রশাসনের উচিত, সবার সঙ্গে বসে এ শ্বাসরুদ্ধকর এবং অনিরাপদ অবস্থার উত্তরণের পথ খুঁজে বের করা।
খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার আলী আহমদ বলেন, যৌথ বাহিনীর নেতৃত্বে তল্লাশি চালানো হবে। অবৈধ অস্ত্রধারীরা জনগণের মাঝেই লুকিয়ে আছে। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।